তাঁদের কান্না ছুঁয়ে গেল সবাইকে

সাভারে রানা প্লাজা ধসে দুই ছেলে উজ্জ্বল হোসেন ও আফজাল এবং পুত্রবধূ খাদিজা আক্তারকে হারিয়েছেন আবুল কাশেম। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বললেন, ‘রানা প্লাজা আমার সব নিয়ে গেছে। ঘটনার পাঁচ দিন পর বড় ছেলে ও বউয়ের লাশ পেলেও ছোট ছেলেরটা পাইনি।...’
কান্না সামলে কথা শেষ করতে পারেন না আবুল কাশেম। সন্তানহারা এক মা আঞ্জুআরা বেগম। তিনি বললেন, ‘হৃদয়ে অনেক কান্না। দুই বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছি। বিয়ের সাত বছরে সন্তান হয়নি। তারপর একটি ছেলে হলো। শখ করে নাম রাখলাম হৃদয় হোসেন। রানা প্লাজার ছয়তলায় কাজ করত। ঘটনার দিন সকালে ডাল-ভাত খেয়ে কাজে গেল। আর ফিরল না।’ কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেন তিনি। এরপর বললেন, ‘কী ক্ষতিপূরণ দিবে? আমার হৃদয়কে কি কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবো?’
নিহত মতিউরের স্ত্রী মিলি খাতুন, আহত শ্রমিক ইয়ানূর ও জুয়েল শেখও রানা প্লাজা ধসের কথা বলতে গিয়ে কাঁদলেন। তাঁদের সেই কান্না ছুঁয়ে গেল মিলনায়তনে উপস্থিত শ্রোতা ও অতিথিদের। তাঁদেরও কেউ কেউ চোখ মুছলেন। রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে গতকাল শুক্রবার সকালে আবেগঘন এই দৃশ্য তৈরি হয়। সেখানে ২৪ এপ্রিল: হাজার প্রাণের চিৎকার সংকলনের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন রানা প্লাজা ধসে নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিক পরিবারের সদস্য, আহত শ্রমিক ও উদ্ধারকর্মীরা।
রানা প্লাজা ধসে নিহত-নিখোঁজ শ্রমিকদের জীবনসংগ্রাম, স্বপ্ন ও স্বপ্ন হারানোর গল্প, আহত শ্রমিক ও উদ্ধারকর্মীদের দুঃসহ স্মৃতি এবং নিহত-নিখোঁজদের নামের তালিকা ইত্যাদি নিয়ে সংকলনটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি। সংগঠনের সমন্বয়ক তাসলিসা আখতার বলেন, ‘রানা প্লাজার ঘটনাকে ভুলিয়ে দেওয়ার আয়োজন চলছে চারদিকে। সে জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে করে আমরা বারবার তাঁদের কথা এবং তাঁদের মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী সেটি স্মরণ করি।’
ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরাই ছিলেন অনুষ্ঠানের অতিথি। তাঁরাই সংকলনের মোড়ক উন্মোচন করেন। তাঁদের বক্তব্য, আর কোনো শ্রমিক যেন এমন করুণ মৃত্যুর শিকার না হয়। অপরাধীদের যেন দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, শ্রমিকনেতারা।
সংকলনের তথ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে ৫৯ জেলার এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত ও নিখোঁজ হন। এঁদের মধ্যে ৮৩৫ জনের লাশ প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হয় ও তিন দফা ডিএনএ পরীক্ষায় ১৭৮ জনের পরিচয় নিশ্চিত হয়। তবে ডিএনএ নমুনা মিললেও ১৭ জনের কবর জুরাইনে শনাক্ত করা যায়নি। নিখোঁজ শ্রমিকের সংখ্যা ১৬২। নিহত-নিখোঁজ সবার নাম-ঠিকানা তালিকাসহ সংকলনে আছে। সরকার ও পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাবে রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকের সংখ্যা এক হাজার ১৩৬ জন।
নিহত ও নিখোঁজ এক হাজার ১৭৫ জনের মধ্যে এক হাজার ২৩ জনের বয়স জানতে পেরেছে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি। সেই হিসাবে, ১৩-১৭ বছর বয়সের শ্রমিকের সংখ্যা ৩৯, ১৮-২৫ বছরের ৫৮৯, ২৬-৩৩ বছরের ২৫৭, ৩৪-৪০ বছরের ৯৮, ৪১-৫০ বছরের ২৯ এবং পঞ্চাশোর্ধ্ব শ্রমিকের সংখ্যা ১১ জন। তাঁদের মধ্যে নারী ৭১৫ ও পুরুষ শ্রমিক ৪৬০ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘রাষ্ট্র যে কত নৃশংস, কত উদাসীন, তা রানা প্লাজা ধসের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। রাষ্ট্রের নৃশংসতার কথা এই জন্য বলব, যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা এই রাষ্ট্রের লোক। তারা বড় দুই রাজনৈতিক দলের লোক। তাই তারা শাস্তি তো দূরে থাক, কোনো ক্ষতিপূরণও দেয়নি।’ তিনি বলেন, সংকলটিতে শুধু হাজার প্রাণের চিৎকার নয়; ধিক্কার, কান্না, প্রতিবাদ আছে, যা ইতিহাস হয়ে থাকবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের পর এক বছর আট মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু ভুক্তভোগীরা এক টাকাও ক্ষতিপূরণ পেল না। ক্ষতিপূরণ তো দূরে থাক, কোনো নীতিমালাই করতে পারেনি সরকার।’ তিনি বলেন, বিজিএমইএ গত এক বছরে সরকারের কাছ থেকে তিন হাজার কোটি টাকার সুবিধা নিয়েছে। এর ৫ ভাগের ১ ভাগ টাকা দিয়েই ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেত।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আহমেদ কামাল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিউতি সবুর, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি প্রমুখ। নিহত শ্রমিক সাগরিকার বোন বকুল ও আহত শ্রমিক হৃদয় নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন।
৪৮০ পৃষ্ঠার এই সংকলনে নিহত ও নিখোঁজ ২১ জন শ্রমিকের জীবনের গল্প আছে। আহত কিংবা পঙ্গু হয়েছেন এমন ছয়জনের কথাও আছে। ১৭ দিনের উদ্ধার কার্যক্রম নিয়ে লিখেছেন ১০ জন উদ্ধারকর্মী। সব মিলিয়ে ১৬০ জনের লেখা, আলোকচিত্র, কবিতা, কার্টুন, পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ইত্যাদি স্থান পেয়েছে সংকলনে। রানা প্লাজা, তাজরীন ও বিভিন্ন পোশাক কারখানায় প্রাণ হারানো সব শ্রমিকের স্মৃতির উদ্দেশে সংকলনটি উৎসর্গ করা হয়েছে।