সুখরঞ্জন সমাদ্দার

সুখরঞ্জন সমাদ্দার
সুখরঞ্জন সমাদ্দার

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক ছিলেন সুখরঞ্জন সমাদ্দার। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার মানুষ হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি সংগীতচর্চা করতেন।
একাত্তরের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে তাঁর ৭১ বি বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা, পশ্চিম পাড়ার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। সেনারা তাঁকে সেদিনই হত্যা করে বিনোদপুরের এক দিঘির পাড়ে ফেলে রাখে।
এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় তাঁর স্ত্রী চম্পা সমাদ্দারের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ১৩ ও ১৪ এপ্রিলের কথা আজও আমার মনে আছে। ১৩ এপ্রিল হানাদার পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী শহরে ঢুকে পড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত একজন বাঙালি ইপিআর সেনা (প্রতিরোধযোদ্ধা) অন্ধকারে চুপি চুপি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাসার পেছনে এসে পানি চাচ্ছিল। আমার স্বামী তাঁকে নিজ হাতে পানি খাওয়ান। ওই ইপিআর সেনাকে আশ্রয় দিলে বিপদ হতে পারে জেনেও তাঁকে আশ্রয় দেন। তাঁর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছিল। আমার স্বামী নিজ হাতে সে স্থান বেঁধে দিয়ে সারা রাত তাঁর সেবা করেন। রাত চারটার পর ওই যোদ্ধা চলে যান।

‘পরদিন ১৪ এপ্রিল সকাল আনুমানিক সাড়ে নয়টার দিকে হানাদার সেনারা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন অবাঙালি চেয়ারম্যান সৈয়দ মতিউর রহমানের ইঙ্গিতেই আমার স্বামী গ্রেপ্তার হন।
‘হানাদার বাহিনীর ঘাতকেরা তাঁকে সেদিনই নির্মমভাবে হত্যা করে বিনোদপুরে ফেলে রেখে যায়। এটা তখন আমি জানতাম না। পরে জেনেছি। আমাদের বাসায় প্রতিদিন দুধ দিতেন এক ঘোষ। তিনি বিনোদপুরে এক দিঘির পাড়ে আমার স্বামীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি আমার স্বামীর মৃতদেহ তাঁর কাজলার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে উঠোনে মাটিচাপা দিয়ে রাখেন। তিনি সেদিনই পরিবারসহ ভারতে চলে যান। ফলে আমাকে খবর দিতে পারেননি। স্বাধীনতার পর ফিরে এসে তিনি ঘটনাটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানান। তখন কর্তৃপক্ষ তাঁর দেহাবশেষ সেখান থেকে তুলে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে পুনঃসমাহিত করে।’
চম্পা সমাদ্দার আরও বলেন, ১৯৬৩ সালে (২৭ ফাল্গুন) আমাদের বিয়ে হয়। আমার ৮ বছরের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল। এই স্বল্প সময়ে আমার স্বামী আমাকে স্নেহ-মমতা-প্রেম-ভালোবাসায় আবৃত করে রেখেছিলেন। ছাত্রদের স্নেহ করতেন পুত্রবৎ। অন্যায়কে কখনো প্রশ্রয় দেননি। বিপদ হতে পারে জেনেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন।
স্বাধীনতার পর আমি খুব অসহায় অবস্থায় পড়ি। আমার স্বামীর চাকরি ১০ বছর পূর্ণ না হওয়ায় আমি তাঁর পেনশন বা এককালীন কোনো টাকা পাইনি। তখন শুধু ম্যাট্রিক পাস ছিলাম। তখনকার উপাচার্য খান সারওয়ার মুরশিদের অনুপ্রেরণায় আমি আবার পড়াশোনা শুরু করি। আইএ, বিএ ও এমএ পাস করে রোকেয়া হলের সহকারী হাউস টিউটর হয়ে চাকরিতে যোগ দেই। এর আগ পর্যন্ত অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে সংসার খরচ বাবদ প্রতি মাসে নয় শ টাকা করে দিয়েছে। ২০০৬ সালে অবসর নিয়েছি।’
সুখরঞ্জন সমাদ্দারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি। বরিশালের বানারিপাড়া উপজেলার ইলুহার গ্রামে। বাবা কার্তিকচন্দ্র সমাদ্দার, মা প্রফুল্লবালা সমাদ্দার। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। স্থানীয় বাইশহারী স্কুল থেকে মাট্রিক (১৯৫২), বরিশাল বিএম কলেজ থেকে আই পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখান থেকে বিএ (অনার্স) পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এমএ করেন।
পড়াশোনা শেষে প্রথমে গোপলগঞ্জ কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। ছেলে সলিলরঞ্জন সমাদ্দার চিকিৎসক, মেয়ে মল্লিকা সমাদ্দার ও সুস্মিতা সমাদ্দার, দুজনই শিক্ষকতা করেন।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৩) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
[email protected]
ঘোষণা: শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের অনেকের ঠিকানা ও ফোন নম্বর না থাকায় আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। তাঁদের ওপরের মেইলে কিংবা ০১৭২৭৫২২০১৬ মোবাইল নম্বরে অথবা সরাসরি যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।—সম্পাদক