বিরল বেগুনি কোকিল

পুরুষ বেগুনি কোকিল। ছবিটি গত ১ জুন বিকেলে হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে তোলা ষ ছবি: লেখক
পুরুষ বেগুনি কোকিল। ছবিটি গত ১ জুন বিকেলে হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে তোলা ষ ছবি: লেখক

৫ জুলাই যে গল্পের অবতারণা করেছিলাম, আজ তা শেষ করব। আগেই বলেছি, দুর্লভ ও বিরল পাখির খোঁজে দেশের বনবাদাড়ে ঘুরছি বছর খানেক। তারই অংশ হিসেবে গত ৩১ মে সহকর্মী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলাম হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে। দুপুর নাগাদ পৌঁছে বিকেলটা কাজে লাগাতে চাইছিলাম। কিন্তু বিধি বাম!
রাস্তা অবরোধের কারণে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। উদ্যানের কাছে গিয়েই দেখি ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা বন্ধু মুনির আহমেদ খান ও তাঁর সহধর্মিণী এবং পাখি বিশেষজ্ঞ তানিয়া খান আমাদের অপেক্ষায় গাছতলায় বসে আছেন। একসঙ্গে চা পর্ব সেরে আমরা গেস্টহাউসে গেলাম। ভোর থেকে তিন দিনের মিশন শুরু হবে।
যে দুটি পাখি নিয়ে এই মিশন, তার দ্বিতীয়টি অর্থাৎ পান্না কোকিলের গল্প ইতিমধ্যেই বলেছি। আজ বলব প্রথমটির কথা। তানিয়া খানকে নিয়ে সকালের মিশনে বের হই। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ওর দেখা মিলল না। এরপর বেলা তিনটায় মুনির ভাইয়ের সঙ্গে বের হলাম। যাত্রার শুরুতেই সুতানালি সাপের দেখা পেলাম। পটাপট দুটি ক্লিক করে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। পাশের ন্যাড়া গাছটায় অবিরাম ‘কুরক্-কুরক্-কুরক্-কুরক্-কুরক্’ স্বরে ডেকে চলেছে ডোরা বসন্ত বাউরি। ওর দিকে মনোযোগ দেওয়ার আগেই মুনির ভাইয়ের ফিসফিসানি। চুপিসারে পাশের ঝোপালো গাছটার দিকে গেলাম। যা দেখলাম, তাতে চোখ জুড়িয়ে গেল। পিঠের বেগুনি রংটা যেন চকচক করছে। কিন্তু পাতার আড়ালে থাকায় ঠিকমতো ফ্রেমে আনতে পারছিলাম না। আকাশ মেঘলা থাকায় পাখির রংটাও ক্যামেরায় ভালো দেখাচ্ছিল না। তার পরও দুটি ক্লিক করলাম। সে আরও ঘন পাতার আড়ালে চলে গেল। ইতিমধ্যে তার সঙ্গিনীরও দেখা পেলাম। তবে একটা ক্লিক করার সঙ্গে সঙ্গে সে উড়াল দিল। সঙ্গে পুরুষটিও। মনটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেল। ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষার পরও যখন ফিরে এল না, তখন রণে ভঙ্গ দিলাম। ওদের আর দেখা পেলাম না।
এতক্ষণ যে জুটির কথা বললাম, তারা আর কেউ নয়। এ দেশের বিরল এক কোকিল প্রজাতি—বেগুনি কোকিল (Violet Cuckoo)। ওটা বেগুনি পাপিয়া নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Chrysococcyx xanthorhynchus অর্থাৎ হলুদঠোঁট সোনাপাপিয়া।
অতিসুন্দর বেগুনি কোকিল এ দেশে প্রাপ্ত আবাসিক-পরিযায়ী কোকিল প্রজাতিগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্রতম। লম্বায় মাত্র ১৭ সেন্টিমিটার। স্ত্রী ও পুরুষের রঙে ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষের মাথা-ঘাড়-গলা-থুতনি-পিঠ ও বুকের ওপরের পালকগুলো চকচকে বেগুনি। আর তাতে সূর্যের আলো পড়লে যেন ধাতব দ্যুতি ছড়াতে থাকে। বুক-পেটের নিচটা সাদা, তার ওপর বেগুনি-বাদামি ডোরা। লেজ কালচে, আগা সাদা। লেজের বাইরের পালকের প্রান্তে সাদা ডোরা। স্ত্রীর দেহের ওপরের পালকগুলো ব্রোঞ্জ রঙা। দেহের নিচের অংশ সাদা ও তাতে ফিতার মতো সাজানো সবুজাভ-ব্রোঞ্জ ডোরা। লেজ সবুজাভ, আগা সাদা। চোখের চারদিকে টকটকে লাল রিং দেখা যায়। পুরুষের ঠোঁট উজ্জ্বল কমলা, স্ত্রীরটি অনুজ্জ্বল হলুদ। পা, পায়ের পাতা ও নখ কালচে। অপ্রাপ্তবয়স্কগুলো দেখতে অনেকটা মায়ের মতো।
বেগুনি কোকিল প্রধানত চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। মূলত সিলেট বিভাগে দেখা যায়। একাকী, জোড়ায় বা চার-ছয়টির দলে বিচরণ করে। শুঁয়াপোকা, ছারপোকা ও নরম পোকামাকড় খেতে পছন্দ করে। বেশ দ্রুত উড়তে পারে। এরা আবাসিক পাখি হলেও অত্যন্ত লাজুক। পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে বলে সারা বছর নজরে আসে না। কেবল প্রজননের সময় পুরুষ পাখি দিনভর ও পূর্ণিমা রাতে জোড়ে জোড়ে ও দ্রুত লয়ে ‘চি-উইক-চি-উইক-চি-উইক-চি-উইক’ স্বরে ডাকে বলে নজরে আসে।
মে-জুন প্রজননকাল। অন্যান্য কোকিলের ন্যায় এরাও বাসা বানায় না। স্ত্রী কোকিল চুপিসারে মৌটুসি বা মাকড়সারভূকের বাসার মুখে ডিম ছেড়ে দিয়ে আসে। যদিও আকারে কিছুটা বড়, কিন্তু ধাত্রী পাখির ডিমের রঙের সঙ্গে মিল রেখে ডিম পাড়ে। সাদা রঙের ডিমগুলোয় উজ্জ্বল বা লালচে বাদামি ছিট থাকে। এই বেগুনি কোকিলগুলো বেঁচে থাকুক অনন্তকাল—এই কামনা করি।