রাজপথে শিক্ষার্থী, ঢাকা অচল

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘টিউশন ফি’র ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল রাজধানীতে সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। ছবিটি উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ মোড় এলাকা থেকে তুলেছেন l প্রথম আলো
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘টিউশন ফি’র ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল রাজধানীতে সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। ছবিটি উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ মোড় এলাকা থেকে তুলেছেন l প্রথম আলো

মেঘলা আকাশ, কখনো টিপটিপ বৃষ্টি। ফুটপাতে হাজারো মানুষের ঢল। রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে গাড়ির সারি। ভাদ্রের ভাপসা গরমের মধ্যেই ঘামে-বৃষ্টিতে ভিজে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে নগরবাসী। কারও কাঁধে ব্যাগ, কারও কোলে শিশু। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীজুড়ে ছিল এমন চিত্র।
ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো আটকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করায় অচল হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা, যা যানবাহনের চাকা থামিয়ে নগরবাসীকে ভোগায়। বেলা ১১টা থেকে শুরু হওয়া এই নাগরিক ভোগান্তি চলে রাত পর্যন্ত।
শুধু ঢাকা নয়, প্রচণ্ড যানজটে একইভাবে ভুগতে হয়েছে চট্টগ্রামবাসীকে। সিলেট শহরের বাসিন্দারাও কম ভোগেননি। রাজশাহীতে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে একই দাবি জানিয়েছেন।
পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিন নগরের অন্তত ১৫টি জায়গায় ৩০টিরও বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দিনভর পথ আটকে বিক্ষোভ করেছেন। শিক্ষার্থীরা ‘নো ভ্যাট, গুলি কর’, ‘ভ্যাট দেব না, গুলি কর’ ইত্যাদি স্লোগান দেন ও প্ল্যাকার্ড বহন করেন। তবে তাঁরা ভাঙচুর করেননি, সংঘর্ষেও জড়াননি। এর মধ্যে ঢাকায় অন্তত নয়টি স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশ রাস্তায় অবস্থান করলেও বাধা দেয়নি বা লাঠিপেটা করেনি। সন্ধ্যার পরও ধানমন্ডি, উত্তরা ও রামপুরায় অবরোধকারীদের অবস্থান ছিল।

ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে রাজধানীর ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে রাপা প্লাজার সামনের রাস্তা অবরোধ করে গতকাল বিক্ষোভ করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাত নয়টার দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালায় একদল যুবক l ছবি: প্রথম আলো
ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে রাজধানীর ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে রাপা প্লাজার সামনের রাস্তা অবরোধ করে গতকাল বিক্ষোভ করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাত নয়টার দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালায় একদল যুবক l ছবি: প্রথম আলো

তবে রাত নয়টার দিকে ধানমন্ডিতে অবরোধকারীদের লাঠিপেটা করে তাড়িয়ে দেয় একদল তরুণ। এ সময় হামলাকারীরা জয় বাংলা স্লোগান দেয়।
দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮৩টি, যেগুলোর মধ্যে গুণগত মান বজায় রাখতে পারছে বড়জোর ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। বাকিগুলোর লেখাপড়ার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একের পর এক মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়ায় বেসরকারি পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা ঘিরে নৈরাজ্য চলে আসছে, অভিযোগ রয়েছে সনদ কেনাবেচারও।
এরই মধ্যে গত জুনে জাতীয় বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপর ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপের ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, যা পরে কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়। এর প্রতিবাদে কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা।
তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই ভ্যাট শিক্ষার্থীদের দিতে হবে। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলে দিয়েছে, ছাত্রদের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়নি। ভ্যাট পরিশোধ করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এনবিআর যেভাবেই ব্যাখ্যা দিক, এই ভ্যাট শিক্ষার্থীদের দিতে হবে।
তিন মাস ধরে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি উত্থাপন ও এ-সংক্রান্ত বক্তব্য-বিবৃতির ধারাবাহিকতায় গত বুধবার রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। তাঁদের সরাতে পুলিশ লাঠিপেটা, রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। এতে অন্তত ৩০ জন আহত হন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শটগানের স্প্লিন্টার বিদ্ধ শরীরের ছবি রাতেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও আন্দোলনে নামতে আহ্বান জানানো হয়। এই আহ্বান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গতকাল সকাল থেকে রাস্তায় নামতে থাকেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
গতকাল বেলা ১১টার পর থেকে ঢাকার রাস্তাগুলো অবরোধ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, নর্দ্দায় বসুন্ধরার ফটকে নর্থ সাউথ ও ইনডিপেনডেন্ট, মহাখালীতে ব্র্যাক, কাকলীতে এআইইউবি, ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে ড্যাফোডিল, সাতমসজিদ সড়কে স্টেট, স্ট্যামফোর্ড, আগারগাঁওয়ে গ্রিন, উত্তরায় এশিয়ানসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ও শ্যামলীতে আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন। এতে তীব্র যানজট তৈরি হয় নগরজুড়ে। বিকেলে অফিসপাড়ায় ছুটির ঢল নামলে রাস্তাগুলো পুরোপুরি আটকে যায়। হাজারো মানুষ ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করে।
দুর্ভোগের রাজধানী: যানজটে পড়ে গতকাল প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টারও বেশি সময় গাড়িতে বসে ছিলেন অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার। তিনি জানান, বেলা ১১টায় সেন্ট্রাল রোডের বাসা থেকে উত্তরা সানবিম স্কুলের উদ্দেশে রওনা দিয়ে আড়াইটায় পৌঁছান। সন্ধ্যায় শিল্পকলায় তাঁর একক নাটক কোকিলারার মঞ্চায়ন। তাই স্কুলে দেরি না করে পৌনে তিনটার দিকে তিনি শিল্পকলার উদ্দেশে রওনা দেন। পৌঁছান সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে।
গাবতলী থেকে সদরঘাটের বাসের চালক মো. জুলহাস জানালেন, তিনি বেলা আড়াইটার দিকে গাবতলী থেকে বাস ছেড়েছেন। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় কারওয়ান বাজারে যখন জুলহাসের সঙ্গে কথা হয়, তখন তাঁর বাসে কোনো যাত্রী নেই। হতাশ জুলহাস বলেন, তাঁদের নিয়মিত পথ মিরপুর রোড, নিউমার্কেট হয়ে সদরঘাট। কিন্তু মিরপুর সড়কে অবরোধ থাকায় তিনি ফার্মগেট হয়ে ঢুকেছেন। ফার্মগেট থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত এক কিলোমিটার পথেই তাঁর দুই ঘণ্টা কেটে গেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির কারণে দিনভর প্রচণ্ড যানজট ছিল। কোনো সংঘর্ষ, লাঠিপেটা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শেষ হয়েছে।