দেশি চাঁদিঠোঁট

বসে আছে দেশি চাঁদিঠোঁট, কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া এলাকা থেকে তোলা ছবি ষ লেখক
বসে আছে দেশি চাঁদিঠোঁট, কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া এলাকা থেকে তোলা ছবি ষ লেখক

বছর পাঁচেক আগে পদ্মার চরে পাখি দেখতে গিয়েছিলাম। মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এলাকার একটি চর। জোয়ারের কারণে পুরো চর পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। সেই হাঁটুজলের মধ্যে হেঁটে হেঁটে যখন একটি উঁচু জায়গায় এলাম, তখন এক জোড়া পাখি দেখতে পাই। দুটি চড়ুই আকৃতির পাখি দূর থেকে উড়ে এসে বসেছে নদীর চরের এক ছোট গুল্ম উদ্ভিদের ডালে। পাখি দুটির চোখে সতর্ক দৃষ্টি আর আনমনা ভাব। মনে হচ্ছে আবার উড়াল দিয়ে চলে যাবে অন্য কোথাও। কিছুক্ষণ বাদেই নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময় করে পাখি দুটি উড়াল দিল। সেই প্রথম দেশি চাঁদিঠোঁট পাখি দেখা ও চেনা।এরপর ২০১০ সালে কেরানীগঞ্জের আড়াকুল ও ইকুরিয়া গ্রামে গিয়ে একসঙ্গে এ পাখির বেশ কয়েকটি দল দেখতে পাই। লম্বা ঘাসের ওপর বসে ছিল পাখিগুলো। তখন শীতের দিন। পাখিগুলো একটি অপরটির গা ঘেঁষে বসে ছিল। আমি ছবি তোলার জন্য কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা উড়াল দিল। সকাল থেকে বিকেল অবধি ওদের পেছনে পেছনেই ছিলাম। পাখিগুলো মাঝে মাঝে মাটিতে নেমে ঘাসবীজ খাচ্ছিল। যখন খুব রোদ বাড়ল, তখন ওরা ঘাসের ছায়ায় লুকিয়ে পড়ল। রোদ শেষে যখন বিকেল ঘনিয়ে এল, তখন আবার ঘাস-লতাপাতার আড়াল থেকে বের হলো খাবার খেতে। কোনোটি আবার ঘাসের ওপর বসেই ঘাসবীজ ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছিল।

দেশি চাঁদিঠোঁট বসবাসের জন্য নিরাপদ জায়গা পছন্দ করে। মানুষের সমাগম দেখলে পালিয়ে যায়। ইকুরিয়া ও আড়াকুল গ্রামের জলাভূমির কাছে বেড়ে ওঠা কাশ, শণ ও ঘাসবনে বেশ কয়েক বছর দেশি চাঁদিঠোঁট পাখির ভালো সমাগম ছিল। কিন্তু গত দুই বছরে এ পাখির সংখ্যা কমে গেছে। চারদিকে আবাসন কোম্পানির ভূমি ভরাটের কারণে কাশবন, ছোট গুল্মের ঝোপঝাড় হারিয়ে গেছে। এ কারণেই দেশি চাঁদিঠোঁট দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে এ এলাকা থেকে।

দেশি চাঁদিঠোঁট ধূসর ঠোঁট ও কালো লেজের পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য ১০ সেন্টিমিটার, ওজন ১২ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির সাদা কোমর, দেহের পেছনের অংশ, ডানাসহ পিঠ ফিকে ও মেটে বাদামি। লম্বা সুচালো লেজ কালো। দেহতল সাদাটে। ঠোঁট ত্রিকোনাকার ও ধূসরাভ। পা, পায়ের পাতা ও নখর ধূসরাভ-পাটল রঙের। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা অভিন্ন।

দেশি চাঁদিঠোঁট বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। কাশবন, বালুময় শণবন, নদীতীরের আবাদি জমি ও কাঁটা ঝোপে বিচরণ করে। সচরাচর দলে থাকে। ভূমিতে, ঘাসবনে ও মেঠোপথে লাফিয়ে লাফিয়ে খাবার খোঁজে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে বীজ ও ছোট পোকা। এরা কোনো কোনো সময়ে বাবুই পাখির পরিত্যক্ত বাসায় রাত কাটায়। ওড়ার সময় চিপ ..চিপ... চিপ শব্দে ডাকে।

জুলাই-ডিসেম্বর মাস প্রজনন সময়। কাঁটা ঝোপের দু-তিন মিটার উঁচুতে ঘাস, পাতা, পালক, পশম ও তুলা দিয়ে বলের মতো বাসা বানায় এবং ডিম পাড়ে। ডিমের রং সাদা, সংখ্যায় চার থেকে আটটি। ছেলে ও মেয়ে পাখি দুজনই ডিমে তা দেয় এবং ছানা পালন করে।