শোকের মিছিলে আরেক শোক

তাজিয়া মিছিল
তাজিয়া মিছিল

তাজিয়া মিছিল। কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইনের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে গড়ে ওঠা এক শোকের মিছিল। মিছিলের পদচারণায় শোক বয়ে যায় পুরান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে। আজ খোদ মিছিলটিই যেন শোকের কারণ। মিছিলের প্রস্তুতিপর্বে হানা দিল প্রাণঘাতী বোমা হামলা। লাশ আর রক্তে শোকের পাশাপাশি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা। আবহমান কাল ধরে চলে আসা এ আয়োজনে প্রথম এ ন্যক্কারজনক ঘটনায় দেখা দিয়েছে বিস্ময়, অবিশ্বাস।
এ হামলায় মারা গেছে কিশোর সাজ্জাদ হোসেন। কারবালার শোক প্রকাশ করতে যাওয়া এ কিশোরের কেরানীগঞ্জের বাড়িতে এখন চলছে শোকের মাতম। পরিবারের সদস্যদের হাত ধরে গতকাল সে গিয়েছিল তাজিয়া মিছিলে, সেই পরিবারের সদস্যদের কাঁধে চড়ে সে বাড়ি ফিরেছে লাশ হয়ে। মাত্র ৪৫ সেকেন্ডের এ ভয়াবহতায় আহত হয়েছে শতাধিক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাঁরা। শোক আর আতঙ্ক এখন পুরো হাসপাতাল জুড়েও।
কে বা কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে? কেন? তাৎক্ষণিকভাবে জানা না গেলেও ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে বিভিন্ন বক্তব্য। সম্প্রতি দুই বিদেশি হত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনায় জঙ্গি সম্পৃক্ততা নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার মাঝে এ ঘটনাটি ঘটল। ফলে বাতাসে ভাসছে জঙ্গি সম্পৃক্ততার সন্দেহও। জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ ঘটনার দায় স্বীকার করেছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে এ সন্দেহ আরও ত্বরান্বিত করে।
কিন্তু এ সন্দেহ একেবারেই উড়িয়ে দিয়ে পুলিশ বলছে, এটি স্বাধীনতাবিরোধীদের কাজ বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন তাঁরা। আজ সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বললেন, এটিকে জঙ্গি হামলা মনে করছে না পুলিশ। এটি পরিকল্পিত নাশকতা। তাঁর যুক্তি, দুই দিন আগে গাবতলী এলাকায় পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কামরাঙ্গীরচর থেকে কিছু বোমা উদ্ধার করা হয়। হোসনি দালানে ব্যবহৃত বোমার সঙ্গে উদ্ধার বোমার হুবহু মিল আছে।
তবে র‍্যাবের পক্ষ থেকে পাওয়া গেছে ‘গ্রেনেডের সাদৃশ্যের’ আরেক তথ্য। আজ সকালে র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে বললেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলে চট্টগ্রামে হামজা ব্রিগেড বলে যে জঙ্গি সংগঠনটিকে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ র‍্যাব গ্রেপ্তার করেছিল তাদের কাছ থেকেও একই ধরনের গ্রেনেড পাওয়া গিয়েছিল। চলতি বছরের ২১ এপ্রিল আশুলিয়ার কাঠগড়ায় কমার্স ব্যাংকের ডাকাতির ঘটনাতেও জঙ্গিরা একই ধরনের গ্রেনেড ব্যবহার করে।
এ তথ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে আজ সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পিতভাবে ও গুছিয়ে এই হামলা চালানো হয়েছে। হামলার ভিডিও ফুটেজ আছে। ফুটেজ দেখে দ্রুত দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা হবে। কোনো সন্দেহের কথা উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী গত শুক্রবার রাতে বললেন, জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
তবে ঘটনাটি নিয়ে সরগরম রাজনৈতিক অঙ্গনও। হামলার ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের মদদ বলে ধারণা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আজ সকালে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, যারা সরকারকে অস্থিতিশীল করতে চায়, যারা সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ঈর্ষাবোধ করে, যারা সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে চায় তারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে মদদ দিতে পারে।
তবে আওয়ামী লীগের সংবাদ সম্মেলনের পরে আজ দুপুরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘হোসনি দালানের ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অবিলম্বে দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি করছি।’
এদিকে ঘটনার ভয়াবহতা বাংলাদেশের সীমানা ছেড়ে ছুঁয়েছে বিশ্বগণমাধ্যমও। খবর প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি, রয়টার্স, বিবিসিসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। আতঙ্ক বয়ে চলছে দেশজুড়ে। কড়া পুলিশি নিরাপত্তা দেখা গেছে রাজধানী জুড়ে। ঘটনায় আতঙ্কিত দেশে থাকা বিদেশিরাও। ঘটনার পর বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন টুইটারে লিখেছেন, ‘আশুরা উপলক্ষে শিয়া সম্প্রদায়ের শোভাযাত্রায় এ হামলার ঘটনায় আমি আতঙ্কিত।’