অ্যাসিড দমাতে পারেনি 'মেয়ে' বাবলিকে

বাবলি এখন পড়ছে রাজধানীর লালমাটিয়া বালিকা বিদ্যালয়ে, অষ্টম শ্রেণিতে। এবার ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দিচ্ছে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
বাবলি এখন পড়ছে রাজধানীর লালমাটিয়া বালিকা বিদ্যালয়ে, অষ্টম শ্রেণিতে। এবার ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দিচ্ছে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কোমর পর্যন্ত ঘন, কিছুটা ঢেউখেলানো কোঁকড়ানো চুল। লিকলিকে শরীর। চোখে, মুখে কিশোরীর উচ্ছলতা। আবার পর মুহূর্তেই কালবৈশাখীর কালো ঝড়ে পুরো মুখ ঢেকে যায় তার। ঝড়ের পরেই আবার রোদের ঝলকানি। এই হলো বাবলি। শুধু মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণেই জন্মের ছয় মাসের মাথায় বাবা ওর মুখে, কানে, পায়ে, পায়ুপথে ওষুধ খাওয়ার ড্রপারে করে পাঁচ দিন ধরে অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছিলেন।
বাবলি এখন পড়ছে রাজধানীর লালমাটিয়া বালিকা বিদ্যালয়ে, অষ্টম শ্রেণিতে। এবার ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দিচ্ছে। মনে বেশ খানিকটা জেদও কাজ করে। ও ওই লোকটাকে (বাবা ডাকে না) দেখিয়ে দিতে চায়, মেয়ে হয়েও জীবনে অনেক কিছু করা সম্ভব। বাবলি এখন আর ওই সব দিনের কথা ভাবতে চায় না। বা ইচ্ছা করেই ভুলে থাকতে চায়। বাবলি দৃঢ় কণ্ঠেই বলে, ‘আমি চাই মানুষ আমাকে দেখে শিখুক। আমার তো কোনো অন্যায় নেই। তাই আমার কথা বলতে লজ্জা পাই না। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করব। মাকে দেখব।’
কিশোরী মনের ভাবনা জানিয়ে বাবলি বলে, ‘প্রথম ভাবছিলাম ডাক্তার হব, কিন্তু এখন আর ভালো লাগছে না। মাঝে মাঝে ভাবি কমার্স নিয়ে পড়ব। একবার ভাবি সাংবাদিক হব। আমার মতো নিশ্চয়ই আরও অনেকে আছে, সাংবাদিক হলে ওদের কথা লিখতে পারব।’
ছোট বেলা থেকেই বাবলি ভালো নাচে। মা পারুল আক্তারের সঙ্গে গানও গায়। কিন্তু অ্যাসিডে মুখের তালুর সঙ্গে জিহ্বা লেপ্টে গেছে। মুখ থেকে কখনোই জিহ্বা বের করতে পারে না। দুই ঠোঁট প্রায় লেগে গেছে বলে মুখ অল্প একটু ফাঁক করতে পারে। মুখের ভেতরে দাঁতগুলো আঁকাবাঁকা। তাই কথা অস্পষ্ট। শুধু কথা অস্পষ্ট নয়, ও এখন পর্যন্ত ভাত না চটকিয়ে খেতে পারে না। মাংসসহ শক্ত জিনিস খেতে পারে না। বাবলির এক পাশের কান পুরোটা নেই। এক পায়ের প্রায় সবগুলো আঙুল বেকে গেছে। বাবলি বলে, ‘আমি মনে মনে ভাবি, আমার চেহারায় কিছু না হলে আমি দেখতে কেমন হতাম? সবকিছু খেতে পেলে নিশ্চয়ই আরেকটু লম্বা হতাম। তখন তো দেখতে অন্য বন্ধুদের মতোই লাগত।’ 

এ পর্যন্ত বাবলির শরীরে সাত থেকে আটটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। মুখে আর কানে আরও দুইটি বড় অস্ত্রোপচার করতে হবে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কাটাসূরের বাসায় কথা হয় বাবলি ও তার মা পারুলের সঙ্গে। মা বেসরকারি টেলিভিশনের এক গাড়ি চালককে বিয়ে করেছেন। তাই বাবলি নতুন বাবা পেয়েছে। সেই সঙ্গে আট মাস বয়সী নিহারীকা নামের বোন পেয়েছে। ছোট বোনের চেহারা দেখে বাবলি অনেক কেঁদেছে। কেননা বাবলিও তো ছোট ছিল, তার দোষটা কোথায় ছিল। এখনকার বাবা ছোট বোনকে যখন আদর করে তখনো মনে মনে ভাবে বাবা মনে হয় এমনই হয়। আবার নতুন বাবা যখন বাবলির পড়াশোনার জন্য তাগাদা দিয়ে শাসন করেন তখন ঠিক মানতে পারে না বাবলি। কেননা বাবারা কীভাবে শাসন করে তা তো তার জানা নেই। বাবা বলতে মায়ের সঙ্গে বিয়ের সময় তোলা একজনের একটি ছবি। এর বাইরে তার তো আর কোনো স্মৃতি নেই। ছবির ওই লোকটা এখন দেখতে কেমন হয়েছে তাই বা কে জানে।
বাবলির জন্মদাতা বাবার সঙ্গে পারুল আক্তারের বিয়ে হয় ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে বাবলির জন্ম। যখন বাবলি পেটে তখনই বলতেন তিনি মেয়ে সন্তান চান না। জন্মের পর বাবা তিন মাস মেয়ের মুখ দেখেননি। ছয় মাস বয়সে স্বামী মা ও মেয়েকে চট্টগ্রামে বাড়িতে নিয়ে যান।
পারুল বলেন, ‘বাবলিরে পাঁচ দিন ধরে অ্যাসিড মারছে ওর বাবা। কানে, পায়ে, পায়খানার রাস্তাসহ বিভিন্ন জায়গায় অ্যাসিড মারার পর কালো হয়ে যায়। ঘা হয়। তখন বলে মেয়ের বাত হইছে। যেদিন মুখের ভেতরে অ্যাসিড দেয় ওই দিন বাবলি বমি করে দেয়। আমার শাড়ির যে জায়গায় বমি পড়ে ওই সব জায়গা পুড়ে যায়। শ্বশুর ভালো মানুষ ছিলেন। তিনিই টাকা দিয়ে আমাকে আর বাবলিকে ঢাকায় পাঠান। হাসপাতালে ভর্তি করান। তারপর বাবলির বাবা পালিয়ে যান।’
চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা এবং এর পর বিভিন্ন সময় প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় বাবলিকে নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বাবলি নিজের মনের নানান চিন্তা লিখে রেখেছে তার লেখার প্যাডে। ও লিখেছে-‘ফুল তো সুন্দর। আমি কি সুন্দর?’ কথা বলতে বলতেই বলে, ‘বাবা জিনিসটা কেমন? আমার বন্ধুরা বলেছে, বাবারা নাকি মেয়েকে বেশি ভালোবাসে। বেশি আদর করে। আমিও তো ছোট ছিলাম। আমার কি দোষ ছিল? আমি ওই লোকটার (বাবা) কাছে একদিন না একদিন এই প্রশ্নটা করবই। শুধু মেয়ে বলেই কি আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল?’
বাবলি ছোট বেলা থেকেই তার বাবার অন্য রকম একটি গল্প শুনে শুনে বড় হচ্ছে। তবে যত বড় হচ্ছে ততই বিষয়টি তাকে ভাবিয়ে তুলছে। বিয়ে, পুরুষ মানুষ নিয়ে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়েছে মনে। তার ভাষায়, ছেলেরা তো অনেক খারাপ।
দুই বছর আগে আরেক বিয়ে করার আগ পর্যন্ত পারুল একাই সংগ্রাম করেছেন বাবলিকে নিয়ে। পারুল এখন মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করছেন বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রে। এর আগে বাবলিকে নিয়ে সংগ্রামের সময় পাশে পেয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা সামন্ত লাল সেন এবং এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশনকে (এএসএফ)। এখনো বাবলিকে মাসে ৮০০ টাকা করে দিচ্ছে এ সংগঠন। মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পারুলের বিয়ে হয়। এএসএফের সহায়তায় স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন পারুল। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য স্বামীর পরিবার থেকে মাঝেমধ্যে অনুরোধও জানানো হয়েছে। পারুল রাজি হননি। তবে মামলা করার পর এত বছরেও স্বামীর কিছু হয়নি। একদিনের জন্যও জেলখানায় যেতে হয়নি। নতুন বউ, সন্তান নিয়ে দিব্যি সংসার করছেন।

পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করতে চায় বাবলি। চায় মায়ের দেখভাল করতে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করতে চায় বাবলি। চায় মায়ের দেখভাল করতে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন