আ.লীগের ৩৩ জন

পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের ৩৩ জন কোটিপতি। অনেকের কাছে নগদ অর্থ আছে কোটি টাকার বেশি। এর বাইরে কিছু প্রার্থী আছেন যাঁদের সম্পদ, আয় ও ব্যাংকঋণের মধ্যে সামঞ্জস্য নেই।
আওয়ামী লীগের ২১৩ জন প্রার্থীর হলফনামা পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে না থাকায় এবং অস্পষ্টতার কারণে এই দলের অন্য ২০ জনের হলফনামা পর্যালোচনা করা যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশন সচিবালয়ের সচিব সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিশ্চয় কোনো সমস্যা হয়েছে যে কারণে হলফনামা আপলোড করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে দেখব। আর যেগুলো অস্পষ্ট আছে সেগুলো পরে নতুন করে আপলোড করা হবে।’
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২১৩ প্রার্থীর মধ্যে ১১২ জনের মধ্যে মামলা আছে বা ছিল, এর মধ্যে ৩৫ জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা আছে এবং অন্যদের বিরুদ্ধে এখন না থাকলেও অতীতে ছিল। আর ১০১ জনের নামে মামলা নেই, অতীতেও ছিল না। এই প্রার্থীদের মধ্যে ৩৬ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে। ৮৫ জন প্রার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এবং ৯২ জন এসএসসি বা এইচএসসি পাস। প্রার্থীদের পেশায় ১৪০ জন ব্যবসায়ী, এর মধ্যে ৩৫ জন ঠিকাদার। বাকিরা কৃষি, শিক্ষকতা, আইনসহ অন্যান্য পেশার।
কোটিপতি প্রার্থী: ৩৩ জন কোটিপতি প্রার্থীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চাঁদপুরের ছেংগারচরের রফিকুল আলম, যশোরের জহিরুল ইসলাম চাকলাদার, জয়পুরহাটের মোস্তাফিজুর রহমান, জামালপুরের মাদারগঞ্জের মির্জা গোলাম কিবরিয়া, মাগুরার খুরশিদ হায়দার, নওগাঁর দেওয়ান ছেকার আহমেদ, শেরপুরের নালিতাবাড়ীর আবু বকর সিদ্দিক, শেরপুরের গোলাম মো. কিবরিয়া, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের আনোয়ার হোসেন, মাদারীপুরের খালিদ হোসেন, মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিমের শহীদুল ইসলাম, মুন্সিগঞ্জের মো. ফয়সল, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় গোলাম কিবরিয়া, নারায়ণগঞ্জের তারাবর হাছিনা গাজী, নরসিংদীর মো. কামরুজ্জামান, নেত্রকোনার নজরুল ইসলাম খান, বগুড়ার সান্তাহারের রাশেদুল ইসলাম, চট্টগ্রামের রাউজানের দেবাশীষ পালিত, ঢাকার সাভারের আবদুল গনি, দিনাজপুরের আনোয়ারুল ইসলাম, ফেনীর পরশুরামের নিজামউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, নাটোরের উমা চৌধুরী, লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের ইসমাইল খোকন ও গোবিন্দগঞ্জের (গাইবান্ধা) আতাউর রহমান প্রমুখ। প্রার্থীদের অনেকে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব উল্লেখ করেননি। কারও কারও আয়ের সঙ্গে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মিল পাওয়া যায়নি।
মাদারগঞ্জের মির্জা গোলাম কিবরিয়ার স্থাবর সম্পদের মূল্য ১০ লাখ টাকা। নগদ, ব্যাংক ও স্থায়ী আমানত হিসেবে আছে ৫৫ লাখ টাকা। অন্যান্য সম্পদের মূল্য ১৪ লাখ টাকা। তাঁর স্ত্রীর নামে আছে ৭৫ ভরি স্বর্ণ। বছরে তাঁর আয় ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। তবে ন্যাশনাল ব্যাংকে (এনবিএল) তাঁর ঋণ আছে ৮০ লাখ টাকা। পেশায় ঠিকাদার নওগাঁর দেওয়ান ছেকার আহমেদের আয় ৭২ লাখ টাকা। তিনি কয়েক কোটি টাকার সম্পদের বিবরণ দিয়েছেন। মাদারীপুরের খালিদ হোসেনের আয় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। তারাবর হাছিনা গাজীর আয় ১৩ লাখ টাকা। তাঁর স্থায়ী আমানতের পরিমাণ ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
নরসিংদীর মো. কামরুজ্জামানের বছরে আয় ১ কোটি টাকা। তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো একটি কার এবং একটি করে পিস্তল ও শটগান। ব্যাংকে তাঁর জমা আছে ৫৭ লাখ টাকা। গোবিন্দগঞ্জের আতাউর রহমানের আয় সাত লাখের বেশি। তাঁর স্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে চার একর কৃষিজমি ও এক একর অকৃষি জমি, একটি তিনতলা বাড়ি, ধানের চাতাল ও একটি মার্কেট। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে নগদ দুই লাখ টাকা, দুটি গাড়ি ও একটি করে পিস্তল ও শটগান।
চাঁদপুরের ছেংগারচরের প্রার্থী রফিকুল আলম পুরোনো গাড়ির ব্যবসায়ী। তিনি সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছেন নয় কোটি টাকার বেশি। তাঁর বছরে আয় ১০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। যশোরের জহিরুল ইসলাম চাকলাদার ব্যবসা থেকে আয় করেন ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। তাঁর কাছে নগদে আছে ১২ লাখ এবং ব্যাংকে জমা ৫০ লাখ টাকা উল্লেখযোগ্য।
৩৫ শতাংশ ব্যাংকের কাছে ঋণী: হিসাব অনুযায়ী ৩৫ শতাংশের বেশি প্রার্থীর ব্যাংকঋণ রয়েছে। বেশির ভাগের ঋণ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকে। অনেকের ঋণের টাকার সঙ্গে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও আয়ের মিল পাওয়া যায়নি। খোকসার তারিকুল ইসলামের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ উল্লেখযোগ্য নয়। তবে পাট ও ভুসি মালের ব্যবসা থেকে বছরে তাঁর আয় দেড় লাখ টাকা। জনতা ব্যাংকে তাঁর ঋণ আছে ২০ লাখ টাকার। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে মানিকগঞ্জের রমজান আলীর ঋণের পরিমাণ ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। কিন্তু তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ এবং বার্ষিক আয় তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। নওহাটার আবদুল বারীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বলতে পাঁচ বিঘা কৃষি ও অকৃষি জমি এবং ব্যাংকে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অথচ উত্তরা ব্যাংকে তাঁর ঋণের পরিমাণ ৩০ লাখ টাকা। তিনি বছরে আয় করেন ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
স্বর্ণের মালিক: পাটগ্রামের শমশের আলীর নিজ নামে জমিজমা ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ ২০ ভরি স্বর্ণ আছে। তাঁর স্ত্রীর নামে ৬৫ শতাংশ জমি ও একটি স্টিলের আলমারি আছে। শেরপুরের গোলাম মো. কিবরিয়ার আয় বছরে ১৫ লাখ টাকা। স্ত্রীর চেয়ে (৪০ ভরি) তাঁর নিজের (৫০ ভরি) স্বর্ণের পরিমাণ বেশি। শ্রীবর্দীর আবু সাঈদের স্ত্রীর নামে কোনো স্বর্ণ না থাকলেও নিজের নামে আছে ১০ ভরি। কটিয়াদীর শওকত উসমানের কাছে আছে ২৫ ভরি স্বর্ণ। এ ছাড়া আরও অনেক প্রার্থীর কাছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্বর্ণ আছে বলে তাঁরা হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।
নগদ টাকার ছড়াছড়ি: মুন্সিগঞ্জের মো. ফয়সলের আয় বছরে ৯৯ লাখ টাকা। তাঁর কাছে নগদে আছে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। জয়পুরহাটের মোস্তাফিজুর রহমানের বছরে আয় ১২ লাখ টাকা। তাঁর কাছে নগদে আছে এক কোটি টাকা এবং তাঁর স্ত্রীর আছে ১৪ কোটি। মাগুরার খুরশিদ হায়দারের কাছে নগদে আছে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা। কৃষি থেকে বছরে তাঁর আয় ৪০ হাজার টাকা। কলাপাড়ার বিপুল চন্দ্র হাওলাদারের কাছে নগদে আছে ৯৫ লাখ টাকা। তাঁর আয় বছরে ৭৫ লাখ টাকা। নালিতাবাড়ীর আবু বকর সিদ্দিকের আয় ২৫ লাখ টাকা। তাঁর কাছে নগদে আছে ৬৩ লাখ টাকা। স্বরূপকাঠির গোলাম কবিরের উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদ না থাকলেও নগদে আছে ১১ লাখ টাকা। মদনের সাইফুল ইসলামের কাছে নগদে আছে ৫০ লাখ টাকা।
বর্তমানে মামলা আছে: ৩৫ জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা আছে। এঁদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে অতীতেও মামলা ছিল। কেন্দুয়ার মেয়র পদপ্রার্থী আসাদুল হকের বিরুদ্ধে একটি হত্যাসহ দুটি মামলা বিচারাধীন আছে। অতীতে তাঁর নামে একটি মামলা ছিল। কালকিনির এনায়েত হোসেনের দুটি মামলা বিচারাধীন। অতীতে তিনি দুটি মামলা থেকে খালাস পান। নরসিংদীর মো. কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে একটি হত্যাসহ দুটি মামলা বিচারাধীন আছে। অতীতে তিনি পাঁচটি মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন। কাটাখালীর আব্বাস আলীর বিরুদ্ধে একটি হত্যাসহ পাঁচটি মামলা বিচারাধীন আছে। অতীতে তিনি ছয়টি মামলা থেকে অব্যাহতি পান। ধুনটের শরিফুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে চারটি মামলা আছে। অতীতে তিনি তিনটি মামলা থেকে খালাস বা অব্যাহতি পান। দেওয়ানগঞ্জের শাহনেওয়াজ শাহান শাহের বিরুদ্ধে সাতটি মামলা চলমান আছে। অতীতে একটি হত্যাসহ তিনটি মামলা থেকে খালাস পান তিনি। শৈলকুপার কাজী আশরাফুল আজমের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা বিচারাধীন। মোহনগঞ্জের লতিফুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি মামলা বিচারাধীন। অতীতে তিনি একটি হত্যাসহ দুটি মামলা থেকে খালাস পান। কাঁকনহাটের আবদুল মজিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যাসহ দুটি মামলা চলমান। অতীতে তিনি একটি মামলা থেকে অব্যাহতি পান।
এ ছাড়াও বর্তমানে হরিণাকুণ্ডের শাহিনুর রহমান, বোরহানউদ্দিনের মো. মনিরুজ্জামান, গাংনীর আহমেদ আলী, গফরগাঁওয়ের এস এম ইকবাল হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সামিউল হক, সৈয়দপুরের সাখাওয়াত হোসেন, সান্তাহারের রাশেদুল ইসলাম ও বারইয়ারহাটের নিজামউদ্দিনের বিরুদ্ধে এক বা একাধিক মামলা আছে।
অতীতে মামলা ছিল: ৪০ জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা না থাকলেও অতীতে ছিল। এঁদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে হত্যা ও হত্যারচেষ্টার মামলা ছিল। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। বেশির ভাগ অব্যাহতি বা নিষ্পত্তির মাধ্যমে খালাস পেয়েছে। হাতিয়া পৌরসভার মেয়র পদপ্রার্থী এ কে এম ইউছুপ আলীর একটি মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং ছয়টি থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। মাটিরাঙ্গার প্রার্থী শামছুল হকের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যাচেষ্টাসহ নয়টি মামলা ছিল। মুন্সিগঞ্জের মো. ফয়সল একটি হত্যাসহ দুটি মামলা থেকে খালাস পান। রহনপুরের গোলাম রাব্বানী বিশ্বাস একটি হত্যা মামলা থেকে খালাস পান। সারিয়াকান্দির আলমগীর শাহী একটি হত্যাসহ চারটি মামলা থেকে খালাস পান। রাউজানের দেবাশীষ পালিত হত্যা, হত্যাচেষ্টাসহ ১১টি মামলা থেকে খালাস পান। তাঁর একটি মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়।
শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে: এসএসসির নিচের শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী প্রার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জয়পুরহাটের মোস্তাফিজুর রহমান, মেলান্দহের শফিক জাহেদী, হরিণাকুণ্ডের শাহিনুর রহমান, শৈলকুপার কাজী আশরাফুল আজম, নওগাঁর দেওয়ান ছেকার আহমেদ, ভবানীগঞ্জের আবদুল মালেক, ভেদরগঞ্জের আবদুল মান্নান হাওলাদার, নালিতাবাড়ীর আবু বকর সিদ্দিক, শ্রীবর্দীর আবু সাঈদ, কুলিয়ারচরের আবুল হাসান, মীরকাদিমের শহিদুল ইসলাম, নান্দাইলের রফিক উদ্দিন ভুইয়া, রহনপুরের গোলাম রাব্বানী বিশ্বাস, রাজশাহীর দুর্গাপুরের তোফাজ্জল হোসেন, পুঠিয়ার রবিউল ইসলাম। এসব প্রার্থীর কয়েকজন নিজেদের স্বশিক্ষিত বলে দাবি করেছেন।

হলফনামা: আ. লীগ
প্রার্থী পর্যালোচনা ২১৩
কোটিপতি ৩৩
ব্যবসায়ী ১৪০
মামলা ১১২
স্নাতক ৮৫
এসএসসির নিচে ৩৬