পাতালে গৌরবের ইতিহাস

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তৈরি স্বাধীনতা জাদুঘরে ছবি দেখছেন এক দর্শনার্থী l ছবি: প্রথম আলো
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তৈরি স্বাধীনতা জাদুঘরে ছবি দেখছেন এক দর্শনার্থী l ছবি: প্রথম আলো

ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দীর্ঘ ১৬ বছরের প্রকল্প শেষে চালু হয়েছে ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’। তাতে তুলে ধরা হয়েছে দেশ-জাতির গৌরবময় ইতিহাস ও সংগ্রামের ছবি। তবে নিদর্শনের স্বল্পতা, আলোর অভাব, চারপাশের আবর্জনাময় পরিবেশের কারণে দর্শকেরা খানিকটা অতৃপ্ত।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ চত্বরের ভূগর্ভে তৈরি করা হয়েছে এই ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’। ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প’ নামে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ২৯ জুন। মোট ২৬২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৪ সালের ৩০ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের একটি বিশেষ সেল। এর ১৫০ ফুট উচ্চতা ও ১৬ বাই ১৬ বর্গফুট আয়তনের কাচের স্তম্ভটির নকশা করেন মেসার্স আরবানা নামের একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাসসুম।
উদ্যানের উত্তর স্বাধীনতা স্তম্ভের মূল স্থাপনা। এর নিচেই স্বাধীনতা জাদুঘর। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এটি পরিচালনা করছে। নিদর্শন সংগ্রহ, প্রদর্শনসহ সামগ্রিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয় জাদুঘরকে। গত বছর স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ থেকে স্বাধীনতা জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। প্রতি বৃহস্পতিবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকে। এ ছাড়া সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা এবং শুক্রবার বেলা আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত খোলা। টিকিট ২০ টাকা।
জাদুঘরে গিয়ে দেখা গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আর উদ্যানে বেড়াতে আসা তরুণ-তরুণীরাই এর প্রধান দর্শক। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে নিদর্শনগুলো সাজানো। নিদর্শন বলতে সবই আলোকচিত্র। ভিন্ন কিছু নেই। মেঝেতে কাচের বড় বড় ফলকের সঙ্গে বেশ সুদৃশ্যভাবেই আলোকচিত্রগুলো প্রদর্শন করা হয়েছে। সঙ্গে সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও রয়েছে। প্রতিটি ফ্রেমে ক্রমিক নম্বর দেওয়া। সেই ক্রম অনুসরণ করে দেখতে থাকলে দর্শকেরা একেবারে দেশের প্রাচীনকালের ভূ-নৃতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর্ব পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি একঝলকে দেখে যেতে পারবেন।
প্রথমেই রয়েছে দেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। বাংলা ভাষার বিবর্তন। প্রাচীন পুণ্ড্রনগর (মহাস্থান), উয়ারী-বটেশ্বর ইত্যাদি। এরপরে ব্রিটিশ আমল, নীল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ, বঙ্গভঙ্গ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভারতের স্বাধীনতা লাভ। পাকিস্তান পর্বে আছে মোহাম্মদ আলী জিন্নার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) সেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষণ ‘উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা’। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে এই ময়দানেই বিশাল জনসভায় দেওয়া হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি। এসব ছবির সঙ্গে আছে উনসত্তরের অভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের দৃশ্য। পশ্চিম দিকের দেয়ালের অনেকটা অংশজুড়ে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের একটি বিশালাকার আলোকচিত্র। তর্জনী উঁচিয়ে জনসমুদ্রে ভাষণ দিচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
মোগল আমল থেকে রেসকোর্স ও পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত এই ঐতিহাসিক ময়দানের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর বেশ কিছু দুর্লভ ছবি রয়েছে।
এরপরের কক্ষটি খানিকটা সংকুচিত, প্যাসেজের মতো। এই অংশটুকুর দুই পাশের দেয়াল ও মেঝে কালো রঙের গ্রানাইট পাথরের টালি দিয়ে ঢাকা। দেয়ালে কালো ফ্রেমে বাঁধাই করা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতার দৃশ্য। যুদ্ধের দৃশ্যমালা শেষ হয়েছে আলোকিত বিজয়ের মধ্য দিয়ে। সামনেই সেই ঐতিহাসিক টেবিল, যার ওপরে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন হানাদারপ্রধান জেনারেল নিয়াজি। দেয়ালে সেই ছবিটিও বড় করে টাঙানো আছে। এরপরে স্বাধীন বাংলাদেশে পর্ব। মোট ১৪৪ নম্বর ফ্রেমের শেষ হয়েছে এই আলোকচিত্রের অভিযাত্রায়।
‘আলোকচিত্রে দেশের ইতিহাস তুলে ধরার প্রদর্শনী হিসেবে বিবেচনা করলে এটি অসাধারণ। অনেক দুর্লভ ছবি আছে।’ মন্তব্য করলেন জাদুঘর দেখতে আসা রাবেয়া সুলতানা। তবে আলোর স্বল্পতার কারণে কিছুটা অস্বস্তি লেগেছে তাঁর। রাবেয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চূড়ান্ত পর্বের শিক্ষার্থী। কয়েক সহপাঠীর সঙ্গে এসেছিলেন জাদুঘর দেখতে। শুধু ছবি দেখে পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারেননি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী খায়রুল আলম। তিনি থাকেন বিজয় ৭১ হলে। বললেন, ছবির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আরও কিছু নিদর্শন থাকলে ভালো হতো। টিকিট বিক্রি করছিলেন জাতীয় জাদুঘরের বিক্রয় সহকারী আইয়ুব আলী। তিনি জানালেন, শুক্রবার ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ জন দর্শক আসেন, অন্য দিনে দর্শকসংখ্যা থাকে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০।
দর্শকদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এখনো পুরোপুরি দায়িত্ব তাঁর কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। যে পরিমাণ আলোর প্রয়োজন, তার মাত্র ৩০ ভাগের ব্যবস্থা করেছে গণপূর্ত বিভাগ। পর্যাপ্ত আলোর জন্য তিনি গণপূর্তকে বলেছেন। এখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দিনে চারবার করে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিগগিরই তা চালু হবে। তবে আলোকচিত্র ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্য নিদর্শন এত বছর পরে সংগ্রহ করা দুরূহ। মূলত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং জাতীয় জাদুঘরে অন্য প্রামাণ্য নিদর্শনগুলো রয়েছে। স্বাধীনতা জাদুঘরটি পরিকল্পনাই করা হয়েছে আলোকচিত্রের মাধ্যমে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সংগ্রামসহ এই ঐতিহাসিক স্থানটির গুরুত্ব ও পরিচিতি তুলে ধরতে। ক্রমান্বয়ে আরও আলোকচিত্র ও তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে জাদুঘরটিকে সমৃদ্ধ করে তোলা হবে। পাশাপাশি অন্য নিদর্শন পাওয়া গেলে তা-ও রাখা হবে।