প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইছে দুই পক্ষই

এইচ এম এরশাদ,রওশন এরশাদ
এইচ এম এরশাদ,রওশন এরশাদ

নতুন কো-চেয়ারম্যান নিযুক্ত ও মহাসচিব বদলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) গত সপ্তাহে তৈরি হওয়া অস্থিরতা নতুন মোড় নিয়েছে। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, এরশাদ ও রওশনের নেতৃত্বাধীন দলের দুই পক্ষই এখন সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চায়। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য পৃথকভাবে চেষ্টা করছে।
এদিকে মাঝে কয়েক দিন পরিস্থিতি দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের অনুকূলে ছিল বলে প্রতীয়মান হলেও গতকাল শনিবার রওশন এরশাদ বিবৃতি দিয়ে নিজের অবস্থান জানান দেন। তিনি এরশাদের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে আখ্যায়িত করেন।
বিবৃতিতে রওশন বলেন, সংসদীয় কমিটি ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের সভায় আলোচনা ছাড়াই দলের চেয়ারম্যান হিসেবে এইচ এম এরশাদ কো-চেয়ারম্যান অর্থাৎ পার্টির ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান নিযুক্ত এবং মহাসচিব পদে যে পরিবর্তন করেছেন, তা রাজনৈতিক দলের নীতিসিদ্ধ নয়, অগণতান্ত্রিক। একই সঙ্গে তিনি তাঁকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করার বিষয়টিও নাকচ করে দেন।
রওশন বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা নিয়ে দলে ও জনমনে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, সেটি সঠিক নয়। কারণ, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা নিয়ে যৌথ সভায় এ ধরনের কোনো আলোচনা হয়নি। তিনি আশা প্রকাশ করেন, দলের বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে এবং দলকে আরও সুসংগঠিত ও সুসংহত করার লক্ষ্যে চেয়ারম্যান এরশাদ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা পুনর্বিবেচনা করবেন।
জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান ঘোষণার এক সপ্তাহের মাথায় রওশনের দেওয়া এই বিবৃতিকে ‘এরশাদের ওপর একটা চাপ’ বলে প্রথম আলোর কাছে মন্তব্য করেন জাপার সদ্য অব্যাহতি পাওয়া মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। আর নবনিযুক্ত মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘ব্যক্তিগত বিবেচনায় কাগজের পাতায় অনেক লেখাই আসে, আসতে পারে। একটি দল চলে গঠনতন্ত্রের বিধানমতে। আমাদের দলের গঠনতন্ত্র চেয়ারম্যানকে যেকোনো সংযোজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধনের এখতিয়ার দিয়েছে। এর বাইরে আর কিছু বলার নেই।’
এরশাদ গত রোববার রংপুরে দলীয় এক সভায় ছোট ভাই জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান ও নিজের উত্তরসূরি ঘোষণা করেন। এরপর মঙ্গলবার ঢাকায় ফিরেই তিনি জিয়াউদ্দিনকে সরিয়ে দিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব নিযুক্ত করেন। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দলে রওশনপন্থী বলে পরিচিত জাপার মন্ত্রী ও সাংসদদের একটি অংশ প্রতিক্রিয়া দেখালেও গতকালের বিবৃতির আগ পর্যন্ত রওশন চুপ ছিলেন। গতকালের বিবৃতিতে তিনি একদিকে স্বামী এরশাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন, অন্যদিকে তাঁকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার পাল্টা ঘোষণারও বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
রওশনের এই ভূমিকায় অস্বস্তিতে পড়েছেন উভয় পক্ষের নেতারা। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, রওশনপন্থী নেতারা এখনো চেষ্টা করছেন রওশনকে নিজেদের পক্ষে রেখে এরশাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাতে। এ জন্য তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টার পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও নেতাদেরও শরণাপন্ন হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, দুই পক্ষই প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। উভয় পক্ষ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য যার যার মতো করে চেষ্টা করছে।
এরশাদের গতকালের বক্তব্যেও এমন ইঙ্গিত রয়েছে। তিনি তাঁর বনানী কার্যালয়ে এক অনির্ধারিত সভায় বলেন, ‘জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করা হলে সংসদ আরও কার্যকর হবে এবং সরকারও লাভবান হবে। আশা করি, আমাদের সংসদ সদস্যরা সংসদে এমন কোনো বক্তব্য রাখবেন না, যাতে করে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।’
নিজের সরকারি পদ ছাড়ার বিষয়ে এরশাদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিশেষ দূত করে আমাকে সম্মানিত করেছেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে এই পদ ছেড়ে দিয়ে তাঁকে অসম্মানিত করতে পারি না। অবশ্যই এ বিষয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব।’ তিনি দলে সাম্প্রতিক পরিবর্তনের পক্ষে আবার নিজের অবস্থান ঘোষণা করে বলেন, দলের প্রয়োজনেই তিনি কো-চেয়ারম্যান নিয়োগ এবং মহাসচিব পদে পরিবর্তন এনেছেন। এই পরিবর্তনে সারা দেশে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে।
এরশাদ ও রওশনের ঘনিষ্ঠ দুজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, নতুন কো-চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে নিয়ে দলের ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া আছে। এর মধ্যে রওশনের অস্বস্তির কারণ নতুন কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের। কারণ, স্বামীর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হয়ে তিনি জাপার হাল ধরতে আগ্রহী ছিলেন বলে দলে আলোচনা আছে। মহাসচিব নিয়ে তাঁর খুব মাথাব্যথা নেই। আবার জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ তাঁর বলয়ের নেতারা কো-চেয়ারম্যান নিয়ে অস্বস্তির পাশাপাশি ক্ষুব্ধ মহাসচিবের পদ হারানোর ঘটনায়।
জাপার একাধিক সূত্র জানায়, রওশনকে ঘিরে আছেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের ফলভোগী মন্ত্রী ও সাংসদের একটি অংশ। আর সাংসদদের একাংশ ও সরকারি সুবিধাবঞ্চিত নেতারা আছেন দলীয় প্রধান এরশাদকে ঘিরে। এরশাদ চাইছেন সরকার থেকে বের হয়ে পরবর্তী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ‘প্রকৃত’ বিরোধী দলের ভূমিকা নিতে। রওশনও তা চান। কিন্তু সরকার থেকে বেরিয়ে এসে এরশাদ কী করে বসেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রওশন ও তাঁর অনুসারীদের। কারণ, এরশাদের চেয়ে রওশন সরকারের কাছে বেশি আস্থাভাজন। এ কারণে রওশন চান না জাপা এমন কোনো ভূমিকায় যাক, যা সরকারকে বিব্রত করে। যদিও এরশাদও চাইছেন, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করেই সরকারবিরোধী ভূমিকায় মাঠে নামতে। কিন্তু রওশনপন্থীরা এরশাদের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না।