কারখানা বন্ধ, তবু প্লট পাওয়া যায় না বিসিকে

সিলেটের ব্যবসা–বাণিজ্য–২
সিলেটের ব্যবসা–বাণিজ্য–২

সিলেটের সুরমা নদীর দুই পারে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) দুটি শিল্পনগরীতে বন্ধ কারখানার সংখ্যা ১৫। বন্ধ থাকলে বিসিকের নিয়ম অনুযায়ী কারখানা কর্তৃপক্ষের প্লট বাতিল করে নতুনদের দেওয়ার কথা।
সিলেটের দুই বিসিকে তা করা হচ্ছে না। একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, সিলেটে ÿক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের মালিকেরা প্লট পেতে হন্যে হয়ে ঘুরছেন।
তবে দুই বিসিকের অধিকাংশ প্লটই এখন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে। তাঁদের অনেকে কারখানা চালাতে না পারলেও বিসিক কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ বাতিল করছেন না। কোনো কারখানার মালিক যদি স্বেচ্ছায় বিক্রি করেন, তবেই সেখানে প্লট পাওয়া যায়। আর যাঁরা প্লট পেয়ে কারখানা করেছেন, তাঁরা ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট ও পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা নাজুক হওয়ার সমস্যার কথা বলেছেন।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার গোটাটিকরে ১৯৬৬ সালে প্রথম বিসিক শিল্পনগরী স্থাপন করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার। সেখানে বিভিন্ন আকারের ১৩৪ প্লট ৭২টি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এখন নয়টি কারখানা বন্ধ, একটি নির্মাণাধীন। অন্যদিকে ১৯৯৩ সালে উত্তর সুরমার খাদিমনগরে আরেকটি শিল্পনগরী স্থাপন করে বিসিক। এখানে ১১৯টি বিভিন্ন আকারের প্লট ৭৭টি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ৬৭টি কারখানা। বন্ধ ৬টি। আর চালুর প্রক্রিয়ায় আছে ৪টি কারখানা।
বিসিকের কর্মকর্তারা জানান, সিলেটের দুই শিল্পনগরীতে বেকারি ও খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনের কারখানা আছে ৬৭টি। এ ছাড়া প্রকৌশল ৩১, কেমিক্যাল ১৭, বস্ত্রজাত ৭, আসবাব ৩, পেপার বোর্ড ও প্রিন্টিংয়ের ৬টি কারখানা আছে। অন্য কারখানা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ৮টি।
জানতে চাইলে গোটাটিকর বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা শেখ ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সাপ্পান আহমেদ চৌধুরী নামে এক ব্যবসায়ীর কারখানা চার-পাঁচ বছর ধরে বন্ধ। তাঁর নামে বরাদ্দকৃত তিনটি প্লটই বিসিক বাতিল করেছে। তবে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করেছেন এবং পরে শিল্পসচিবের কাছে ছয় মাসের সময় চেয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া চারটি কারখানার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে বিভিন্ন ব্যাংকের মামলা আছে। আর দুটি কারখানা গ্যাসের সংযোগ না পাওয়ায় উৎপাদন শুরু করতে পারছে না।
খাদিমনগর বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা সৈয়দ বখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বন্ধ ছয়টি কারখানাকে আমরা প্রায়ই চিঠি দিচ্ছি। তাদের মধ্যে পাঁচটি আমাদের কথা দিয়েছে, শিগগিরই তারা প্লট অন্য মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেবে।’ বাতিল করছেন না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানবিক কারণেই করা হচ্ছে না। কারণ, বাতিল করলে তো যে টাকা দিয়ে প্লট কিনেছিল, সেটি পাবে না। তাই আমরা প্রতিনিয়ত বিক্রি করার জন্য চাপ দিচ্ছি।
কথা প্রসঙ্গে সৈয়দ বখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘প্রতিমাসেই দু-তিনজন ব্যবসায়ী প্লট নিতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’ এ বিষয়ে কী উদ্যোগ নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে খাদিমনগর শিল্পনগরীকে বর্ধিত করার একটি প্রকল্প প্রস্তাব দুই বছর আগে আমরা জমা দিই। এতে ১০ একর জমির ওপর ৪০-৪৫টি প্লট করার কথা বলা হয়েছে। তবে এখনো প্রকল্পটি পাস হয়নি।’ এটি হয়ে গেলে প্লটের সংকট-সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গত শনিবার খাদিমনগর বিসিক শিল্পনগরী ঘুরে দেখা গেল, পুরো শিল্প এলাকা পুরোটাই অরক্ষিত। কোনো সীমানাদেয়াল নেই। ভেতরের রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা। এ ছাড়া শিল্পবর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আশপাশের ডোবা-নালায় গিয়ে সেসব পড়ছে। পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। কেন্দ্রীয়ভাবে পানির ব্যবস্থা না থাকায় কারখানা কর্তৃপক্ষকে সেটি করতে হয়েছে।
জানতে চাইলে সানটেক টায়ার লিমিটেডের কর্মকর্তা রুবেল আহমেদ বললেন, দীর্ঘদিন সংস্কারকাজ না করায় বর্ষা এলেই হাঁটুপানি জমে সড়কে। প্লটগুলো নিচু হওয়ায় কারখানায় ঢুকে যায় পানি। কোনো সীমানাপ্রাচীর না থাকায় সবাই নিরাপত্তায় ভোগেন।
ইউনাইটেড ইঞ্জিনিয়ার্স নামের চা-বাগানের যন্ত্রপাতি মেরামতের কারখানার মালিক আজাদ হোসেন অভিযোগ করে বললেন, সাধারণ লাইন থেকেই বিসিকের কারখানাগুলোতে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে। এতে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে তাঁদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
এসব বিষয়ে খাদিমনগর বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তারা জানান, গত ২২ বছরে শিল্পনগরীর সড়কগুলোর বড় কোনো সংস্কার হয়নি। তবে সম্প্রতি ৫ কোটি ৯ লাখ টাকার একটি বরাদ্দ পাওয়ার কথা রয়েছে। সেটি হলে সড়ক ও ড্রেন সংস্কার করা হবে।
পরে গোটাটিকর শিল্পনগরীতে গিয়ে দেখা গেল, একটি ছাড়া সব সড়কই ভাঙাচোরা। ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরা। এখানেও কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনে নেই কোনো ব্যবস্থা। মূল সড়কের চেয়ে এখানকার প্লটগুলো নিচু হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে কারখানার ভেতরে পানি উঠে যায় বলে জানালেন পাঁচ-ছয়টি কারখানার কর্মচারীরা।
এ বিষয়ে গোটাটিকর বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা শেখ ফজলুল হক বলেন, ইতিমধ্যে শিল্পনগরের দুটি রাস্তা উঁচু করা হয়েছে, একটির কাজ চলছে। আরেকটি সড়কের সংস্কারের জন্য আগামী মাসে দরপত্র হবে। মালিকদের কেউ কেউ তাঁদের কারখানা উঁচু করছেন। ফলে আগামী মৌসুমে কারখানায় পানি ওঠার সমস্যাটি থাকবে না।
গোটাটিকর বিসিকের শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলিমুল আহসান চৌধুরী বললেন, ‘শিল্পনগরীতে বেকারি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই বেশি। আর এসব কারখানা থেকে যেসব বর্জ্য বের হয়, সেগুলো খুবই বিষাক্ত। এসব বর্জ্য পরিশোধনের জন্য একটি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।’