নাম তার সিংহরাজ

কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে সিংহরাজ। ছবি  লেখক
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে সিংহরাজ। ছবি লেখক

১৯ জানুয়ারি ২০১৩। একদল তরুণ-প্রবীণ পাখি পর্যবেক্ষক-আলোকচিত্রীর সঙ্গে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের (কেএনপি) সর্পিল ছড়া ধরে এগিয়ে চলেছি। ছড়ার কোথাও হাঁটু, কোথাওবা কোমরসমান হিমশীতল পানি। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। প্রায় চার কিলোমিটার পথ হেঁটে রাম পাহাড়ের এক পাশে এসে থামলাম। অনেক আশা ছিল, অন্তত ডজন খানেক পাখির দেখা পাব। কিন্তু আড়াই ঘণ্টা হেঁটেও এক জোড়া কালোপিঠ চেরালেজ পাখি ছাড়া অন্য কিছুর দেখা পেলাম না।
ফিরতি পথে কেএনপির প্রধান ফটকের কাছে একটা সাঁকোর সামনে এসে পৌঁছালাম। কিছুটা ক্লান্ত হয়ে সাঁকোর রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। হঠাৎই কুটুম পাখির মরণ চিৎকারে পাশের বড় গাছটার দিকে ঘুরে তাকালাম। কালো দুঃসাহসী পাখিটি তিরের বেগে উড়ে এসে কুটুম পাখিকে আক্রমণ করল। আর তার ঠোকর খেয়েই এই চিৎকার। ‘অন্য পাখির ডিম চোর’ খ্যাত কুটুম পাখির অসহায় অবস্থা দেখে মায়া লাগল। দুঃসাহসী পাখিটির কাছে টিকতে না পেরে উড়ে গিয়ে বসল পাশের গাছে। এদিকে তখনো রাগে ফুঁসছিল কালো পাখিটি। আমাদের আরও কিছু দেখার বাকি ছিল, যা স্বপ্নেও ভাবিনি। কুটুম পাখিটি যে ডালে বসে ছিল, ওখান দিয়ে যাচ্ছিল এক ইরাবতী কাঠবিড়ালি। হঠাৎ করেই কালো পাখিটি তেড়ে এসে জোরে ওকে মারল এক ঠোকর। ঘটনার আকস্মিকতায় কাঠবিড়ালিটি হকচকিত হয়ে পড়িমরি করে দিল ভোঁ-দৌড়। আমরা থ হয়ে গেলাম। জীবনে এমন দৃশ্য খুব বেশি দেখিনি। এই পাখি এ দেশের ‘পাখির রাজা’ ফিঙের জাত ভাই ‘মহারাজা সিংহরাজ’। তবে ‘ভীমরাজ’ (Greater Racket-tailed Drongo) নামেই বেশি পরিচিত। রাগে ঘাড় ফোলালে সিংহের কেশরের মতো দেখায় বলে খুলনা-বাগেরহাটে এরা সিংহরাজ বলে পরিচিত। তা ছাড়া যখন তিরের বেগে ওড়ে, তখন নাকি বাতাসে সিংহের গর্জনের মতো শব্দ হয়, তাই এই নাম। ডাইক্রুরিডি পরিবারের সদস্য সিংহরাজের বৈজ্ঞানিক নাম Dicrurus paradiseus।  

এরা লম্বায় প্রায় ৩২ সেন্টিমিটার ও ওজনে ১২০ গ্রাম। তারের মতো ১৫-৩০ সেন্টিমিটার লম্বা লেজের বাহির পালক দুটির শেষ প্রান্তে রয়েছে প্যাঁচানো উজ্জ্বল কালো ফিতা বা ‘র‌্যাকেট’। দেহের পালক একনজরে ধাতব দ্যুতিময় নীলচে-কালো। মাথার সামনে সুস্পষ্ট ও চমৎকার ঝুঁটি। ঠোঁট ও পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম।

সিংহরাজ সব প্রাকৃতিক বন, ম্যানগ্রোভ বন ও বাঁশঝাড়ের বাসিন্দা। একাকী বা জোড়ায় থাকে। মূলত উড়ন্ত পোকামাকড় খায়। ফুলের নির্যাসও খেতে পারে।

ফেব্রুয়ারি-জুলাই প্রজনন-কাল। গাছের উঁচু শাখায় সরু শিকড়-বাকড় দিয়ে বাটির মতো বাসা বানায়। স্ত্রী পাখি তাতে দু-চারটি পাটকিলে রঙের ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ১৫-২১ দিনে।