অগ্নিযুগের বিপ্লবী বিভূতিভূষণ সরকার

বিভূতিভূষণ সরকার
বিভূতিভূষণ সরকার

তখন বিপ্লবের কাল। স্কুল-কলেজ ছেড়ে ছাত্ররা দলে দলে বেরিয়ে আসছে রাজপথে। শিক্ষকেরাও বাদ থাকলেন না। বরং তাঁরাই আগে বেরিয়ে এসে পথ দেখালেন। মহিমচন্দ্র দাস ছেড়ে এলেন কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষকতা, শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার ত্যাগ করলেন কাজেম আলী স্কুলের শিক্ষকতা, বিপিন চন্দ্র চৌধুরী ছাড়লেন ডা. খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আদেশ ঘোষিত হওয়ার পর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জনের পালা শুরু হয়। শুধু স্কুল-কলেজ ত্যাগ নয়, বিলাতি পণ্য বর্জন, স্বদেশি গ্রহণ, জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, রাখিবন্ধন ইত্যাদি কর্মপ্রবাহ ও ভাবের জোয়ারে তখন চট্টগ্রাম ভেসে গিয়েছিল।
ওই সময় আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলার পলাতক কিছু আসামি চট্টগ্রামে এসে আত্মগোপন করেন। তাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে চট্টগ্রামের তরুণেরা গড়ে তোলেন গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন। প্রথম মহাযুদ্ধের বোমা-গুলির তুমুল গগনবিদারী গর্জনের মধ্যে ত্রস্ত মানুষ যখন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, তখন একদল তরুণ সেই জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সঙ্গোপেন চট্টগ্রামে বিপ্লবের জমি প্রস্তুতে লেগে গেলেন।
ওই বিপ্লবের কালে মহাকবি নবীনচন্দ্র সেন ও বিপ্লবের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্মধন্য বিপ্লবী রাউজানের মাটিতে চিকদাইর গ্রামে ১৯১৭ সালের ২ মে জন্ম হলো এক শিশুর। বিপ্লবের আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠা ওই শিশুই পরবর্তীকালের কিশোর বিপ্লবী বিভূতিভূষণ সরকার।
তাঁর বেড়ে ওঠার কালেই, ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে বার্মা অয়েল কোম্পানির কর্মী ধর্মঘট ও সে–সম্পর্কিত হরতাল এবং পরবর্তী আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের দীর্ঘ তিন মাসব্যাপী প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক ও কর্মচারীর ধর্মঘট (যা ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক স্ট্রাইক নামে পরিচিত) অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২০ সালের অসহযোগ আন্দোলন, যা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অভূতপূর্ব উন্মাদনা ও প্রাণের বেগ সঞ্চার করেছিল, সে আন্দোলনও প্রথম সূচনা করার গৌরবের অধিকারী চট্টগ্রাম। ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে নাগপুরে কংগ্রেসের অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পূর্বে চট্টগ্রামেই প্রথম অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ হয়; তাই গান্ধীজী ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় ‘ চিটাগাং টু দ্য ফোর’ শিরোনামে প্রবন্ধ লিখে চট্টগ্রামকে কুর্নিশ করেছিলেন।
বিপ্লবের আগুনে তখন ধিকিধিকি জ্বলছিল চট্টগ্রাম; বাতাসে তার বারুদের গন্ধ; দক্ষিণের খোলা বঙ্গোপসাগরে ঘনীভূত হচ্ছিল নিম্নচাপ, যা প্রবল ঘূর্ণাবর্তের শক্তি সঞ্চয় করে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল আছড়ে পড়ে চট্টগ্রামের বুকে।
বিভূতিভূষণ যখন ১৩ বছরের বালক, তখন ১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ভারত কাঁপানো চট্টগ্রাম বিপ্লব সংঘটিত হয়। তত দিনে তিনি বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছেন এবং চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের বিশিষ্ট বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে তাঁকে অস্ত্রাগার আক্রমণ মামলায় অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর সাজা হয় এবং তাঁকে বার্মার (বর্তমানে মিয়ানমার) আকিয়াব প্রদেশের থারওয়াডি জেলে পাঠিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। জেলখানা থেকে তিনি আসন্ন মেট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ জেলখানায় তাঁকে পড়াশোনার সুযোগ দানে অস্বীকার করলে বিভূতিভূষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং ক্ষুব্ধ প্রতিবাদের মাধ্যমে তাঁর অসন্তোষ ব্যক্ত করেন।
মেট্রিক পরীক্ষার দুই মাস আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এরপর বাংলাদেশ একজন মেধাবী ছাত্রের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করল, যিনি বিভিন্ন পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি আইএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয়, বিএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং এমএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেন। তিনি আইসিএস পরীক্ষার জন্য মনোনীত হন; কিন্তু বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে সংস্রবের কারণে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়নি।
অতঃপর বিভূতিভূষণ সরকার শিল্প-উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিলেন। ইতিমধ্যে তিনি চট্টগ্রাম থেকে তাঁর আবাস উঠিয়ে কলকাতায় স্থিত হয়েছেন। সেখানে তিনি বিয়ে করেন। তিনি দক্ষিণ কলকাতার একজন বিখ্যাত ডাক্তারের কন্যা কৃষ্ণার পাণি গ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ৬ হাজার টাকার সামান্য পুঁজি নিয়ে কলকাতার যাদবপুরে একটি মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর স্ত্রীর নামানুসারে এই শিল্পের নামকরণ করেন কৃষ্ণা গ্লাস ওয়ার্কস। তাঁর মেধা ও সুদক্ষ পরিচালনায় কৃষ্ণা গ্লাস ওয়ার্কস অচিরে একটি সুবৃহৎ গ্লাস কনটেইনার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ষাটের দশকের শেষ দিকে এটি ভারতের অন্যতম নেতৃস্থানীয় কাচশিল্পের মর্যাদা লাভ করে। সে সময় যাদবপুর, বারুইপুর ও মুম্বাইতে কৃষ্ণা গ্লাস ফ্যাক্টরির তিনটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ২,৫০০ কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। বিভূতিভূষণ সরকার অল ইন্ডিয়া গ্লাস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং রপ্তানি উন্নয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ ছাড়া তিনি রোটারি ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, দক্ষিণ কলকাতা রোটারি ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন।
বিপ্লবে অংশগ্রহণ যদি বিভূতিভূষণ সরকারের জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় অবদান হয়, তাহলে তাঁর দ্বিতীয় প্রধান কীর্তি হলো তিনি দেশকে একজন বিশ্ববিশ্রুত চিকিৎসক উপহার দিয়েছেন। দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের গর্বিত জনক বিভূতিভূষণ সরকারের এই পুত্র হলেন স্বনামধন্য চিকিৎসক কুনাল সরকার। তিনি একজন কার্ডিয়াক সার্জন। তিনি বর্তমানে কলকাতার মেডিকা সুপার স্পেিশয়ালিটি হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ ভাইস-চেয়ারম্যান এবং কার্ডিয়াক সায়েন্সের প্রধান।
১৯৫৯ সালের ২৮ আগস্ট কলকাতায় কুনাল সরকারের জন্ম। পিতার মতোই অসাধারণ প্রতিভাধর তিনি। এ পর্যন্ত ১৫০০ করোনারি বাইপাস সার্জারি এবং ৭০০ ভাল্ব প্রতিস্থাপন করেছেন।
বিভূতিভূষণ সরকার ১৯৭২ সালে ২২ জানুয়ারি আকস্মিকভাবে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
গত ২ মে থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বর্ণাঢ্য কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তাঁর বছরব্যাপী জন্মশতবর্ষ উৎসব শুরু হয়েছে। সারা বছর ধরে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করা হবে এবং আগামী বছরের ২ মে তাঁর জন্মশতবর্ষ উৎসবের সমাপ্তি টানা হবে।
লেখক: সাংবাদিক