অনন্য স্থাপত্যের মসজিদ

রাজধানীর দক্ষিণখান থানার ফায়দাবাদের বায়তুর রউফ মসজিদ। আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য এ বছর চূড়ান্ত মনোনয়ন পাওয়া বাংলাদেশের দুটি স্থাপনার একটি l ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর দক্ষিণখান থানার ফায়দাবাদের বায়তুর রউফ মসজিদ। আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য এ বছর চূড়ান্ত মনোনয়ন পাওয়া বাংলাদেশের দুটি স্থাপনার একটি l ছবি: প্রথম আলো
ঢাকার বায়তুর রউফ মসজিদের স্থাপত্যের জন্য মেরিনা তাবাসসুম এবং গাইবান্ধায় ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার স্থাপত্যের জন্য কাশেফ মাহবুব চৌধুরী এ পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছেন

আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার। স্থাপত্যের দুনিয়ায় অত্যন্ত সম্মানজনক এ পুরস্কার। এর আগে বাংলাদেশের তিনটি স্থাপত্য এ পুরস্কার জিতলেও সেগুলোর স্থপতি ছিলেন বিদেশি। বেশ কয়েকবার বাংলাদেশি স্থপতিরা এ পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন পেলেও পাওয়া আর হয়ে ওঠেনি।

এবারও বাংলাদেশের দুটি স্থাপনা আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছে। ঢাকার বায়তুর রউফ মসজিদের স্থাপত্যের জন্য মেরিনা তাবাসসুম এবং গাইবান্ধায় ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার স্থাপত্যের জন্য কাশেফ মাহবুব  চৌধুরী এবারের মনোনয়ন পেয়েছেন।
এর আগেও বাংলাদেশের এ দুই স্থপতি পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ২০০৪ সালে যৌথভাবে একটি প্রকল্পের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন মেরিনা ও কাশেফ। ২০১০ সালে আরেকটি প্রকল্পের জন্য মনোনয়ন পান কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। তিনবার পুরস্কার জিতেছে বাংলাদেশের তিনটি স্থাপনা জাতীয় সংসদ ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক হাউজিং প্রকল্প ও রুদ্রপুর স্কুল।
তরুণ স্থপতিদের উদ্ভাবনী ধারণাকে স্বীকৃতি দিতে আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক (একেডিএন) প্রতি তিন বছর পরপর এ পুরস্কার দেয়। এই পুরস্কারের জন্য স্থাপত্য ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব, পরিকল্পনা, ঐতিহাসিক সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

মেরিনা তাবাসসুম
মেরিনা তাবাসসুম

পাশাপাশি স্থাপত্যকলার মাধ্যমে সামাজিক প্রত্যাশা পূরণের বিষয়টিও বিচারকদের বিবেচনায় থাকে। এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচনও হয় অত্যন্ত কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। প্রাথমিকভাবে পাওয়া এন্ট্রি থেকে স্টিয়ারিং কমিটি ও গ্র্যান্ড জুরিবোর্ড বিজয়ী নির্বাচন করে। জুরিবোর্ডের পক্ষ থেকে একজন রিভিউয়ার বা মূল্যায়নকারী প্রতিটি প্রকল্প এলাকায় গিয়ে কমিটির কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। পুরস্কারের অর্থমূল্য ১০ লাখ মার্কিন ডলার।
চলতি বছর এ পুরস্কারের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৩৪৮টি প্রকল্প জমা পড়ে। সেখান থেকে ১৯টি প্রকল্প চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য বাছাই করা হয়। বাংলাদেশের দুটি স্থাপনা ছাড়া চীন, ডেনমার্ক, ইরানসহ বিভিন্ন দেশের ১৭টি স্থাপনা আছে। জানা গেছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করবে আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক শামসুল ওয়ারেস প্রথম আলোকে বলেন, আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা অনেক। বিশ্বের অনেক পুরস্কারই আছে যেগুলোতে শুধু ড্রয়িং আর ডিজাইন পাঠিয়ে দিলেই হয়। কিন্তু আগা খান পুরস্কারের বিচার পদ্ধতি অত্যন্ত দীর্ঘ ও বাস্তবসম্মত। এতে পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের দুজন স্থাপত্যবিদ এবার মনোনয়ন পাওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘দুটি স্থাপত্যই চমৎকার। আমি আশা করব দুজনই এবারের পুরস্কার জিতে আমাদের স্থাপত্যবিদদের পুরস্কার না পাওয়ার বন্ধ্যাত্ব ঘোচাবেন।’
আরেক স্থপতি রবিউল হুসাইন বলেন, বাংলাদেশ থেকে অতীতে কোনো স্থাপত্যবিদ এ পুরস্কার পাননি। তবে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম সার্বিক অবদানের জন্য পুরস্কৃত হন। দেশের দুজন স্থপতির মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের পুরস্কারে মনোনয়ন পাওয়াও গর্বের বিষয়।
বাংলাদেশের তরুণ স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম যে স্থাপনাটির জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন, সেটির অবস্থান রাজধানীর দক্ষিণখান থানার ফায়েদাবাদে। নাম বায়তুর রউফ মসজিদ। আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পূর্ব দিকে গিয়ে রেললাইন পেরিয়ে মসজিদটির অবস্থান। এর স্থাপত্যের বিশেষ দিক হলো, এর বায়ু চলাচলব্যবস্থা ও আলোর চমৎকার বিচ্ছুরণ মসজিদের পরিবেশকে দেয় ভিন্ন মাত্রা। ৭৫৪ বর্গমিটারের মসজিদটির বিশেষত্ব হলো, এখানকার মসজিদের পরিচিত চিত্র ডোম বা মিনার নেই। চতুর্দিকে আটটি পিলারের ওপর এটি তৈরি। এর নকশার বিশেষত্ব হলো, কিবলার দিকে ১৩ ডিগ্রি কোনাকুনি করা একটি থাম। আলো প্রবেশের জন্য চারদিকে রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। সুলতানি আমলের মসজিদের অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছে এর স্থাপত্য।
সেখানকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের অনেক এলাকায় মসজিদ দেখেছি। অনেক ঐতিহাসিক মসজিদও দেখেছি। কিন্তু বায়তুর রউফ মসজিদ অনেক আলাদা। প্রাকৃতিক পরিবেশের বিষয়গুলো অনেক চমৎকারভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। অনেক আলো-বাতাস রয়েছে। শীত বা গরমে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব বোঝা যায় না মসজিদের ভেতর।’
মসজিদের স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম মসজিদটির বিশেষত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মসজিদটি তৈরি হয়েছে একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। প্রচলিত মসজিদগুলোর ধরন থেকে আলাদা। আর মসজিদটি নির্মিত হয়েছে স্থানীয় ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে, অংশগ্রহণমূলক ধারণা থেকে। খরচও এসেছে সবার কাছ থেকে। পরিবেশবান্ধব এবং আলো-বাতাসের বিষয়টি মাথায় রেখে এর ডিজাইন করেছি। ইতিহাস, সংস্কৃতি, আবহাওয়াসহ নানা বিষয় মাথায় রেখে এর নির্মাণ করা হয়েছে। আর ব্যবহৃত সব উপকরণই স্থানীয়।’
তরুণ এ স্থপতি মনে করেন, আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পাওয়া একজন স্থপতির জন্য নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। এর আগেও ২০০৪ সালে এ পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ১৯৯৫ সালে স্নাতক এ স্থপতি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকাজে অবদান রেখেছেন। আরেক স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর সঙ্গে যুগ্মভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘরের নকশা করেছেন মেরিনা। ২০১৫ সাল থেকে নিজস্ব স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস (এমটিএ) পরিচালনা করছেন তিনি।
মেরিনা মনে করেন, ‘আমাদের পরিবেশ ও বসবাসের ক্ষেত্রগুলো নিয়ে স্থপতিদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হয়। আমাদের শহর ও বসতিগুলোর উন্নয়নে যুক্ত করতে হবে সবাইকে। সে কারণে নতুন স্থপতিদের সঠিক পথে পরিচালনা ও পথনির্দেশনা দেওয়া জরুরি।’
বায়তুর রউফ মসজিদ স্থাপত্যের বিশেষত্ব
 পরিচিত চিত্র গম্বুজ বা মিনার নেই। চতুর্দিকে আটটি পিলারের ওপর এটি তৈরি।
 কিবলার দিকে ১৩ ডিগ্রি কোনাকুনি করা একটি থাম। আলো প্রবেশের জন্য চারদিকে রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। সুলতানি আমলের মসজিদের অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছে এর স্থাপত্য।
 মসজিদের ভেতর শীত বা গরমে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব বোঝা যায় না

আগামীকাল পড়ুন: গাইবান্ধার ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার নিয়ে