উচ্ছেদ আতঙ্কে মধুপুর বনের ছয় হাজার গারো-কোচ

মধুপুর বনের জয়নাগাছা গ্রামে কলাখেত। এটি রক্ষিত বনের অংশ, এখন একেই সংরক্ষিত করা হয়েছে l ছবি: ফিলিপ গাইনের সৌজন্যে
মধুপুর বনের জয়নাগাছা গ্রামে কলাখেত। এটি রক্ষিত বনের অংশ, এখন একেই সংরক্ষিত করা হয়েছে l ছবি: ফিলিপ গাইনের সৌজন্যে

টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবন এলাকায় প্রাকৃতিক বনের অল্প অংশই টিকে আছে। ইউক্যালিপটাস, একাশিয়াগাছে ছাওয়া বনবাগানই বেশি। এর মধ্যেও শালপাতার দোল, উঁচু-নিচু লাল মাটির পথ, গারোদের মাটির ঘর টুকরো স্মৃতির মতো এখনো টিকে আছে। এর বাসিন্দাদের মনে এখন উচ্ছেদের আতঙ্ক।
বনের ৯ হাজার একরের বেশি এলাকাজুড়ে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করেছে বন বিভাগ। এই এলাকায় অন্তত ১৩টি গ্রাম আছে। সেগুলোয় গারো নৃগোষ্ঠীর প্রায় ছয় হাজার মানুষের বসবাস। আর আছে কোচ, কিছু বাঙালি পরিবারও। স্থানীয় বাসিন্দা মিহির মৃ বললেন, ‘আমাদের ওপর বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়েছে। বনের আদি বাসিন্দা হয়েও আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’
মধুপুর শালবনের নেতৃস্থানীয় গারো-কোচ, বন বিশেষজ্ঞ এবং বনবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, নিয়মের তোয়াক্কা না করে এখানে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়েছে। তবে প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) ইউনুস আলীর দাবি, নিয়ম কোথাও লঙ্ঘিত হয়নি।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ ও বনসচিব কামাল উদ্দিন আহমেদ মধুপুর বনের অরণখোলা মৌজার ৯১৪৫ দশমিক ৭ একর জমি সংরক্ষিত ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন দেন। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বন আইনের ৬ ধারায় ১৯৮৪ সালেই বনভূমির বিষয়ে দাবি-দাওয়া থাকলে তা দেওয়ার জন্য নোটিশ জারি করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে দাবি-দাওয়া উপস্থাপিত হয়নি। হলেও তা আইনগতভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে।
বন আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী, বনে আগুন জ্বালানো, অনধিকার প্রবেশ, গবাদি পশু চরানো, গাছ কাটা, পাথর, কাঠকয়লা, শিল্পজাত দ্রব্য আহরণ দণ্ডনীয় অপরাধ।
বন আইন, ১৯২৭-এর ৩ থেকে ২০ ধারায় কোনো বন সংরক্ষিত ঘোষণার প্রক্রিয়া উল্লেখ আছে। প্রথমে ৩ ধারায় ফরেস্ট সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা নোটিশ জারি করবেন। এই সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা হন জেলা প্রশাসক বা তাঁর নিয়োজিত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বা সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা। ৩ ধারায় নোটিশ দেওয়ার পর সেখানে বসবাসরত মানুষের আপত্তি শোনা, সেই আপত্তির নিষ্পত্তি করা, নিষ্পত্তি শেষে এলাকায় তা স্থানীয় ভাষায় প্রচার এবং ওই এলাকায় মাইকিং বা ঢেরা পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়ার পরই ২০ ধারায় বন সংরক্ষণ হতে পারে।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন সংরক্ষিত করার কোনো প্রক্রিয়া আমার মাধ্যমে হয়েছে বলে স্মরণ করতে পারি না।’
বনের প্রবীণ বাসিন্দা অজয় মৃ (৬৩) বলেন, ‘১৯৮৪ সালে আমরা আবেদন করেছিলাম। এর কপি এখনো আমার কাছে আছে। এরপর আর এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি বন বিভাগ। এখন হঠাৎ করে ৩০ বছর পর আমরা নোটিশ পেলাম।’
যে ৯ হাজার একর জমি সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে, এর মধ্যে বাড়িঘর, আবাদি জমি মিলিয়ে ২ হাজার ৭৫ একর জমি গারো ও কোচরা ভোগ করছে। সংরক্ষিত বন ঘোষণার পর বেসরকারি সংগঠন সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড), কারিতাস এবং স্থানীয় সংগঠন জয়েনশাহী আদিবাসী পরিষদ এক তাৎক্ষণিক জরিপ চালিয়ে এ চিত্র পায়। জয়েনশাহীর পরিচালক ইউজিন নকরেক বলেন, এসব গ্রামে পরিবারের সংখ্যা ১ হাজার ২৬টি। মানুষ ৫ হাজার ৯৯২ জন।
এ বিষয়ে পরিবেশ ও বনসচিব কামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী বলেন, যারা বনের বাসিন্দা দাবি করছে, তাদের আইনি অধিকার নেই। জায়গা-জমির কোনো কাগজপত্র তো দেখাতে পারেনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা হাসান বলেন, বন বিভাগ বনবাসীদের এ বনের দখলদার মনে করে। এভাবে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে বন রক্ষা সম্ভব হবে না।
এখন যে পরিমাণ জমি সংরক্ষিত করা হয়েছে, তা এমনিতেই রক্ষিত বন হিসেবে চিহ্নিত। এরপরও সেই বনকে সংরক্ষিত করা অযৌক্তিক বলে মনে করেন প্রকৃতিবিদ ফিলিপ গাইন। তিনি বলেন, বিদেশি অর্থে প্রকল্প করার উদ্দেশ্য নিয়েই এবারের সংরক্ষণ। এর উদ্দেশ্য বনকে পর্যটনের ক্ষেত্র বানানো।