ভরত ভায়না বৌদ্ধমন্দির

কেশবপুর উপজেলার ভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে ভরত ভায়না গ্রামে ভরত দেউলের একাংশ। এটি প্রায় দেড় হাজার বছর আগের পুরাকীর্তি l ছবি: মো. সাদ্দাম হোসেন
কেশবপুর উপজেলার ভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে ভরত ভায়না গ্রামে ভরত দেউলের একাংশ। এটি প্রায় দেড় হাজার বছর আগের পুরাকীর্তি l ছবি: মো. সাদ্দাম হোসেন

খুলনা-যশোর সীমান্তে কেশবপুর উপজেলার ভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে ভরত ভায়না গ্রাম। সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আনুমানিক দেড় হাজার বছরেরও বেশি আগের এক পুরাকীর্তি। অনেকটা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মতো দেখতে এই প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনটি স্থানীয় জনগণের কাছে দীর্ঘদিন যাবৎ ভরতের দেউল বা ভরত রাজার দেউল নামে পরিচিত। প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা এখানকার ব্যবহৃত ইট ও প্রাপ্ত বিভিন্ন পোড়ামাটির মূর্তি গবেষণা করে নিশ্চিত হয়েছেন এটি খ্রিষ্টীয় তিন থেকে ছয় শতকে  নির্মিত একটি মন্দির।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনার সহকারী পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা এখানকার ব্যবহৃত ইট ও প্রাপ্ত বিভিন্ন পোড়ামাটির মূর্তি গবেষণা করে ধারণা করেছেন এটি আদি ঐতিহাসিক যুগে নির্মিত একটি  স্থাপনা। তিনি বলেন, দেশে আদি ঐতিহাসিক যুগের স্থাপনা খুব কম আছে। জানামতে, ভরত ভায়না মন্দির দক্ষিণ বঙ্গের একমাত্র আদি ঐতিহাসিক যুগের স্থাপনা।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৯২২ সালে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ এই ঢিবি সংরক্ষণ করে। ১৯২৩ সালে কশিনাথ দীক্ষিত ঢিবিতে জরিপ পরিচালনা করেন এবং মন্তব্য করেন যে ঢিবির নিচে পাঁচ শতকের প্রাচীন একটি বৌদ্ধমন্দির আছে এবং এটি সম্ভবত হিউয়েন-সাং বর্ণিত সমতটের ৩০টি সংঘারামের একটি। সে সময় তিনি কিছু সীমানা পিলারও দেন। সুযোগসন্ধানী মানুষ বিভিন্ন সময়ে সেই সব মূল্যবান সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে গেছে।

প্রাচীন মন্দিরটি ভরত নামধারী এক প্রভাবশালী রাজা নির্মাণ করেছিলেন বলে প্রচলিত। অনুমিত মূল মন্দিরটি ১ একর ২৯ শতক জমির ওপর অবস্থিত। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৮৫ সালে প্রথম এই ঢিবি খনন করে। এক দশক পর ১৯৯৫-৯৬ সালে পুনরায় এখানে খনন করা হয়। তখন থেকে ১৯৯৬-৯৭ বাদে ২০০০-০১ পর্যন্ত প্রতি মৌসুমে খননকাজ অব্যাহত থাকে। খনন এখনো শেষ হয়নি।

খননের ফলে একটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের অংশবিশেষ উন্মোচিত হয়েছে, যা থেকে অনুমান করা হয় যে স্থাপনাটির উপরিকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানের দৃশ্যমান অংশ সম্ভবত বিনষ্ট হওয়া অট্টালিকার ভিত্তি বা উঁচু মঞ্চ।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের করা স্কেচ থেকে দেখা যায়, মোট ৮২টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ ধাপে ধাপে ওপরের দিকে উঠে গেছে। ঢিবির শীর্ষ ধাপটির দেয়াল ৯ ফুট প্রশস্ত। এর মধ্যে ৬ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রস্থের বর্গাকৃতির চারটি প্রকোষ্ঠ আছে। মূল অট্টালিকার প্রধান কক্ষটি এই প্রকোষ্ঠের ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় ধাপের দেয়াল ৩ ফুট চওড়া, এখানে বিভিন্ন আকৃতির ১৯টি প্রকোষ্ঠ আছে। ৩ ফুট ৯ ইঞ্চি চওড়া দেয়ালের তৃতীয় ধাপে প্রকোষ্ঠ ১৮টি। সাড়ে ৩ ফুট চওড়া দেয়ালের চতুর্থ ধাপটিতে ১৯টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ আছে। শেষ ধাপে ১০ থেকে ১৩ ফুট চওড়া দেয়ালের মধ্যে ২২টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ আছে। তার নিচে প্রায় ১০ ফুট চওড়া প্রদক্ষিণ পথ আছে। মূল মন্দিরের চারদিকে চারটি প্রবেশপথ আছে। এগুলোর মধ্যেও এখন পর্যন্ত সাতটি প্রকোষ্ঠ দেখা গেছে। গঠনশৈলী বিবেচনায় পূর্ব দিকটাই এর মূল প্রবেশপথ ছিল বলে ধারণা করা হয়।

 এর নির্মাণে যে ইট ব্যবহার করা হয়েছে, তার পরিমাপ ৩৬ সেন্টিমিটার, ২৬ সেন্টিমিটার ও ৬ সেন্টিমিটার। এত বড় ইট এই অঞ্চলের কোনো পুরাকীর্তিতে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়নি।

স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও গুপ্তযুগের একটি পোড়ামাটির মাথা, পোড়ামাটির মানুষের হাত ও পায়ের কয়েকটি ভগ্ন টুকরা, কয়েকটি মাটির প্রদীপ, অলংকৃত ইটের টুকরা, পদচিহ্ন-সংবলিত দুটি ইটের টুকরা এবং একটি মাটির ক্ষুদ্র পাত্র সংগৃহীত হয়েছে, যা খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরে রক্ষিত আছে।

 খুলনা নগরের দৌলতপুর থেকে ডুমুরিয়ার শাহপুর বাজার হয়ে সামনে মিকশিমিল সড়ক ধরে এগিয়ে ভদ্রা নদীর সেতু পার হয়ে কিছুদূর গেলেই ভরত ভায়না গ্রাম। অসংখ্য গাছগাছালি, বাঁশবাগান আর পাখির কলরবে মেঠো রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলেই দেউলের চূড়া নজরে পড়ে। দেউল প্রাঙ্গণে আছে বিশাল এক বটগাছ। কেশবপুর সদর থেকে এর দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের খর্ণিয়া বা চুকনগর হয়েও খুব সহজে ভরত ভায়নায় যাওয়া যায়।