মসজিদের গ্রাম বেরাইদ

বেরাইদ গ্রামের একটি মসজিদ l প্রথম আলো
বেরাইদ গ্রামের একটি মসজিদ l প্রথম আলো

নদের তীরে গড়ে ওঠা বহু পুরোনো গ্রাম। গ্রামবাসীর কেউ কেউ মাছ ধরার জন্য নদে জাল ফেলছে। শিশুদের দল পানিতে খেলা করছে। বাড়ির পেছনে নদীর ঘাটে হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন মাজায় ব্যস্ত গৃহিণী। ঘাটের কূল ঘেঁষে জমে ওঠা বাজরে আসছে মানুষ। নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের কেনাবেচা চলছে সেখানে। যেন নদকে ঘিরেই তাদের সব।
ঢাকা মহানগরের পূর্ব পাশে বালু নদের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বেরাইদ নামের এই গ্রাম। উত্তর বাড্ডা কিংবা নতুন বাজার থেকে গ্রামটির দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। বর্তমানে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় গাড়িতে অথবা সিএনজিচালিত স্কুটারে যেতে সময় লাগে মাত্র ১৫-২০ মিনিট। ডুমনী ইউনিয়নের ইছাপুর বাজারঘাট থেকে নৌকায় করেও যাওয়া যায় সেখানে।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অতীতে নদীভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য হওয়ার কারণে প্রাচীন বাংলায় মোগল আমলেরও আগে এই এলাকায় জনবসতি গড়ে ওঠে। ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চামড়া, লবণসহ বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা করতেন এই এলাকার আদি বাসিন্দারা। তাঁদের মধ্যে শরীয়ত উল্লাহ তালুকদার, আবদুল গনি ব্যাপারী, হেদায়েতউল্লাহ মোল্লা উল্লেখযোগ্য। ব্যবসায়িক কাজকর্মে সফলও ছিলেন তাঁরা। বেরাইদের সেই আদি পুরুষেরা রেখে গেছেন কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা।
গতকাল সোমবার গিয়ে দেখা যায় গ্রামটির প্রবেশপথে একাধিক জায়গায় লেখা—‘মসজিদের গ্রামে আপনাকে স্বাগতম’। স্থানীয় প্রবীণদের মতে, সুলতানি, মোগল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে তাঁদের আদিপুরুষেরা এখানে মসজিদ নির্মাণ করেন। এখন সর্বমোট ১৫টি মসজিদ রয়েছে গ্রামটিতে। প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে রয়েছে ভূঁইয়াপাড়া জামে মসজিদ (আনুমানিক-১৫০৫ খ্রিষ্টাব্দ), মোড়লপাড়া জামে মসজিদ (১৮৩৩), পূর্বপাড়া জামে মসজিদ (১৮৯৩), আগাড়পাড়া ও চটকীপাড়া জামে মসজিদ (১৮৯৩), আসকারটেক জামে মসজিদ (১৮৮৮), চিনাদীপাড়া জামে মসজিদ (১৮৯৩), আরৈদ্দাপাড়া জামে মসজিদ (১৮৯৬) প্রভৃতি।
পড়ন্ত বিকেলে ভূঁইয়াপাড়া জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে বসে ছিলেন পূর্বপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা মনির হোসেন। বয়স ৯০ ছুঁই ছুঁই। তিনি বলেন, ‘বহুত আগে থেইকাই আমগো গেরামডারে মাইনসে মসজিদের গেরাম বইলা চিনে। কোনো গেরামে এরহম এত পোরান মসজিদ আর আছেনি?’
বেরাইদের সবাই নিজেদের গ্রামকে মসজিদের গ্রাম বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। এসব প্রাচীন মসজিদ দেখতে অনেক জায়গা থেকে লোকজন আসেন। তবে এলাকাবাসীর অনেকেই মনে করেন, আরও অনেক পুরোনো মসজিদ এলাকায় ছিল। না জেনে সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে এখন তাঁরা বেশ সচেতন হয়েছেন। কয়েকটি পুরোনো মসজিদ বর্তমানে নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে।
অনেক আগে থেকেই এই এলাকার মানুষ চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। চামড়া সংরক্ষণের অনেক আড়ত আছে সেখানে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মহাজন আসেন আড়তগুলোতে। বড় বেরাইদ, ছোট বেরাইদ ও ফকিরখালীর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেখা যায় পশুর চামড়া সংরক্ষণের দৃশ্য। পূর্বপাড়া চামড়া আড়তের কর্মী বেলায়েত বলেন, ‘আমরা মূলত সংরক্ষণ করি। এই চামড়া কিনতে অনেক এলাকাত্তন ব্যবসায়ীরা আসেন। আবার অনেক আড়ত থেকে চামড়ার চালান পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’
প্রাচীন এই গ্রামটির পরিবেশ অনেকটা পুরান ঢাকার মতো। ছোট ছোট সরু অলিগলি। গা-ঘেঁষা দালানকোঠা। পুরোনো ঘরবাড়ি যেন এক মুহূর্তেই ভেঙে পড়বে বলে মনে হয়, কিন্তু টিকে আছে বহু বছর ধরে। রাজধানীর ভেতরে অবস্থিত এই গ্রামে এখনো অনেক মাটির ঘরও রয়েছে। এর কিছু আবার দোতলা। আর্থিক সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও মাটির ঘরে বাস করাটা যেন এই এলাকাবাসীর ঐতিহ্য। স্থানীয় বাসিন্দা নূর ইসলাম বলেন, ‘সব মিলিয়ে এখনো প্রায় দুই-আড়াই শর মতো মাটির ঘর আছে। মাটি দিয়ে নির্মিত ঘর আমাদের ঐতিহ্যের একটি অংশ।’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশও অনেক বদলেছে। সেই কষ্টও রয়েছে বেরাইদের মানুষের মধ্যে। একসময়ের স্রোতের কলকল শব্দ এবং সবুজ শ্যামলে ভরপুর সেই বেরাইদ আর আগের মতো নেই। কৃষিজমিতে বালু ফেলে ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন নতুন আবাসিক এলাকা। উঁচু উঁচু দালানকোঠায় ভরে উঠছে গ্রামের অলিগলি।
পূর্ব বেরাইদের প্রবীণ বাসিন্দা রুস্তম আলী বলেন, ‘বছর দশেক আগেও এই গেরামের মানুষ মাছ কিইনা খাইত না। আর এহন নদীতে মাছ নাই নাই বললেই চলে। নদী দূষণে ভরে গেছে। চাষাবাদও হয় না। প্রায় ৯৫ ভাগ জমিতে ঘরবাড়ি উঠে গেছে। এখন শুধু ফকিরখালী এলাকাতেই সামান্য কিছু সবজির চাষ হয়।’
একাধিক এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা বলেন, ‘আমাদের গ্রামটি শহর থেকে বেশি দূরের পথ না। এখন যোগাযোগব্যবস্থাও ভালো। সরকার উদ্যোগ নিলে ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরপুর আমাদের গ্রামটি পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।’