নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র চেনাচ্ছেন তরুণেরা

পানি, পাথর আর মেঘ-পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছনাকান্দিতে পর্যটকদের ভিড়। সম্প্রতি ছবিটি তুলেছেন আনিস মাহমুদ
পানি, পাথর আর মেঘ-পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছনাকান্দিতে পর্যটকদের ভিড়। সম্প্রতি ছবিটি তুলেছেন আনিস মাহমুদ

সিলেটের বিছনাকান্দি কিংবা রাতারগুলের কথা পাঁচ-ছয় বছর আগেও খুব বেশি লোকে জানত না। একইভাবে অপরিচিত ছিল চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের খইয়াছড়া কিংবা শ্রীমঙ্গলের হামহাম ঝরনা। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি তিনাপ সাইতার কিংবা রাঙামাটির ধুপপানি ঝরনার কথাও কি খুব বেশি লোকে জানত! কিন্তু এই জায়গাগুলোই এখন তরুণদের বেড়ানোর প্রধান জায়গা।
তরুণেরা দল বেঁধে এখন এসব এলাকায় বেড়াতে যাচ্ছেন। সেখানে তাঁবু খাটিয়ে রাত্রি যাপন করছেন। প্রতিনিয়তই তাঁরা খুঁজে বের করছেন ভ্রমণের নতুন জায়গা। এ যেন বাংলাদেশকে নতুন করে চেনা।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, ট্যুরিজম বোর্ড এবং পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, এ দেশের সচ্ছল মানুষদের অনেকে বেড়ানোর জন্য সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড বা অন্য কোনো দেশে চলে যাচ্ছেন। আবার অবকাঠামোগত সমস্যা, ভিসা-সংকট, সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলাসহ নানা কারণে ২০১৬ সালে বিদেশি পর্যটকদের বাংলাদেশে আসার সংখ্যাও কমছে। কিন্তু এ দেশের তরুণেরা দেশের ভেতরেই নানা জায়গা খুঁজে বের করছেন।
এমন পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের মতো আজ ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সকলের জন্য পর্যটন: সর্বজনীন পর্যটনের অভিগম্যতা’। এ উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকায় শুরু হচ্ছে পঞ্চম এশীয় পর্যটন মেলা।
ফেসবুকে বাংলাদেশে ভ্রমণবিষয়ক অন্যতম প্রধান গ্রুপের নাম ‘ট্রাভেলারস অব বাংলাদেশ’। দুই লাখ সদস্য এখানে নিয়মিত ভ্রমণসম্পর্কিত নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন। প্রকাশ করেন ছবি। সেখানকার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলা কিংবা সিলেটের মতো প্রচলিত জায়গাগুলো ছাড়াও রাঙামাটির বিলাইছড়ির ধুপপানি ঝরনা, মুপ্পোছড়া ঝরনা, মিরসরাইয়ের খইয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া ঝরনা, বড় কমলদহ এবং ছাগলকান্ধা ঝরনা, খাগড়াছড়ির হাজাছড়া, দীঘিনালার তৈদুছড়া, শ্রীমঙ্গলের হামহাম ঝরনা, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, জাদুকাঠা নদী, দোয়ারাবাজারের সোনালীচেলা, টেকেরঘাটের লাইমস্টোন লেক, খাগড়াছড়ির সাজেক ভ্যালি, বান্দরবানের বগা লেক, নীলগিরি, থানচির নাফাখুম, ঢাকার কাছে দোহারের মৈনাকঘাট, সিলেটের জাফলংয়ের সংগ্রামপুঞ্জি ঝরনা, বিছনাকান্দি, রাতারগুল, মায়াবন, বরিশালের শাপলা বিল শাতলা, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির ভাসমান পেয়ারা বাজার, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর—এসব নতুন স্থানে বেড়াতে যাচ্ছেন তরুণেরা।
বাংলাদেশে ভ্রমণবিষয়ক একটি ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা বিনয় ভ্রদ্র গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এখানকার তরুণেরা নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বের করছেন। আর অল্প সময়ের মধ্যেই এসব স্থানে বেড়াতে যাচ্ছেন মানুষজন। এভাবেই একের পর এক নতুন স্থান জনপ্রিয় হচ্ছে।
ভ্রমণবিষয়ক আলোকচিত্র সাংবাদিক বিল্লাহ মামুন। তাঁর মতে, তরুণেরা যেসব জায়গায় যাচ্ছেন, অবকাঠামোগত সমস্যা ঠিক করা গেলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সেসব জায়গায় বেড়াতে যাবেন।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান জিয়াউল হক হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেশের প্রায় আট শ জায়গাকে পর্যটন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছি। এর মধ্যে চার শ প্রত্নতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক স্থাপনা আর বাকি চার শ প্রাকৃতিক। এ ছাড়া এ দেশের তরুণেরা নিয়মিত নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বের করছেন। সেগুলোও আমরা পর্যটনস্থান হিসেবে যুক্ত করছি। ইতিমধ্যেই সিলেট বিভাগের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যগুলোও হবে।’
ট্যুর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশের (আটাব) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৫ থেকে ২০ লাখ লোক প্রতিবছর দেশের বাইরে বেড়াতে যান। এর মধ্যে ভারতে যান পাঁচ থেকে ছয় লাখ পর্যটক। এ ছাড়া দেড় লাখ মালয়েশিয়া, এক লাখ পর্যটক থাইল্যান্ডে যান। ৩০ থেকে ৪০ হাজার পর্যটক যান সিঙ্গাপুরে। এ ছাড়া নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা যেতে অন অ্যারাইভাল ভিসা মেলে বলে সেখানেও যাচ্ছেন পর্যটকেরা।
তবে সেই তুলনায় বিদেশ থেকে পর্যটক আসছেন না। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি) ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৬৬৫ জন, ২০১১ সালে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৬৬৭ জন এবং ২০১২ সালে ৫ লাখ ৮৮ হাজার ১৯৩ জন বিদেশি পর্যটক এ দেশে এসেছেন। কিন্তু ২০১৩ সালে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই সংখ্যা ২ লাখ ৭৭ হাজারে নেমে আসে। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা এবং ২০১৫ সালের টানা অবরোধের পর ২০১৬ সালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করা হয়েছিল। এ কারণে ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করে ১০ লাখ বিদেশি আনার লক্ষ্য ঠিক করে সরকার। কিন্তু গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর বিদেশি পর্যটকেরা তাঁদের সফর বাতিল করেন। ফলে এ বছর পর্যটকের সংখ্যা কম হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সরকার। তবে এ বছরের প্রথম ছয় মাসের বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা জানাতে পারেনি বিটিবি ও বিপিসি। একইভাবে ২০১৪, ১৫ ও ১৬ সালে কোন দেশ থেকে কত বিদেশি এসেছেন, সে তথ্যও তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
টোয়াবের সভাপতি তৌফিক উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা বাড়লেও বছরে অন্তত ২০ লাখ লোক দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু সেই তুলনায় বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে আসছেন না। অথচ যত বেশি বিদেশি আসবেন, ততই অর্থনীতি ভালো হবে। কিন্তু বিদেশিদের আনার জন্য যে প্রচার দরকার, সেটি হচ্ছে না। এমনকি ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করলেও সেই কাজটি হচ্ছে না।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে বিদেশি পর্যটক অর্ধেকে নেমে আসে। আমরা ভেবেছিলাম, ২০১৬ সালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু গুলশানের ঘটনা একটা বড় আঘাত। তবে শুধু পর্যটন নয়, সব ক্ষেত্রেই সেটি হয়েছে। তবে আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছি। আমরা আশা করছি, ২০১৮ সাল নাগাদ বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাবে।’