৫ কোটি টাকার হল কাজে আসছে না

২০১৮ সালে নির্মাণ শেষ হলেও ছাত্রীরা এখনো উঠতে পারেননি হলে। হলে সংসার পেতেছেন কর্মচারীরা।

বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে নবনির্মিত ১০০ আসনের ছাত্রী হল এখনো চালু হয়নি। সম্প্রতি তোলা ছবি
প্রথম আলো

বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে ছাত্রীদের আবাসন–সুবিধা বাড়াতে নতুন একটি হল নির্মাণ করা হয় ২০১৮ সালে। ৫ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই হল কোনো কাজে আসছে না। কারণ, সেখানে ছাত্রীরা থাকেন না। সেখানে সংসার পেতেছেন কলেজের কর্মচারীরা।

এ ছাড়া ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষের জেরে ১৩ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে কলেজের ছাত্রদের ৩টি আবাসিক হল। এতে আবাসন–সংকটে রয়েছেন কলেজের ছাত্ররাও।

সরকারি আজিজুল হক কলেজে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স ছাড়াও ২৩টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু রয়েছে। এই কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি।

উচ্চমাধ্যমিকের ফলে এই কলেজ রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে বরাবরই সুনাম ধরে রেখেছে। স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তরের ফলেও সুনাম আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পারফরম্যান্স র‍্যাঙ্কিং’-এ ৬৮৫টি কলেজের মধ্যে এই কলেজের অবস্থান বর্তমানে সারা দেশে তৃতীয়।

এর মধ্যে আকতার আলী মুন হলে ৯৬টি, শহীদ তিতুমীর হলে ৮০ ও শের-ই-বাংলা হলে আসন ৪০টি। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় এসব হলের আসবাব থেকে শুরু করে দরজা-জানালা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, পানির লাইনসহ সব মালামাল চুরি হয়ে গেছে।

২০১৫ সালের আগপর্যন্ত এই কলেজের ছাত্রীদের জন্য একটি হল ছিল। এটির নাম বেগম রোকেয়া হল। এই হলের আসনসংখ্যা ২৫০। তবে ৩৫০ ছাত্রী এই হলে গাদাগাদি করে থাকেন। এর বাইরে বেশির ভাগ ছাত্রী কলেজের আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে কিংবা মেসে থাকেন।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে জেলা সদরে পোস্টগ্র্যাজুয়েট কলেজ উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প থেকে আজিজুল হক কলেজে ছাত্রীদের আবাসন–সংকট নিরসনে ১০০ আসনের নতুন আরও একটি হল নির্মাণের জন্য ৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। হলটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৮ সালে। সেই সময় ছাত্রীদের ওঠার ব্যবস্থা না করে হলটি পঞ্চম তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণের কাজ হাতে নেওয়া হয়।

এত দিন পরিবারসহ শহীদ তিতুমীর আবাসিক হলে থাকতাম। আজ (বুধবার) ছাত্রীদের নতুন হলে উঠেছি
কলেজ মসজিদের মুয়াজ্জিন জাহিদুল ইসলাম

এ জন্য ১ কোটি ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের জুনে সেই কাজ শেষ হয়। এরপর হলের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজে বরাদ্দ দেওয়া হয় আরও ২৯ লাখ টাকা। সেই কাজ শেষ হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। এরপর ২০২০ সালে বিদ্যুতের সাবস্টেশন নির্মাণে বরাদ্দ করা হয় আরও ১১ লাখ টাকা।

সব মিলিয়ে এই হলের পেছনে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আরা খরচ হয়েছে ৫ কোটি ৪ লাখ টাকা। বছরের পর বছর এত অর্থ খরচ করেও ছাত্রীরা এর কোনো সুফল এখনো পাননি।

সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলী বলেন, হলের নির্মাণকাজ ও আসবাব বুঝিয়ে দেওয়া হলেও ছাত্রীদের ডাইনিংরুমে কোনো হাঁড়িপাতিল, থালাবাসনসহ তৈজসপত্র সরবরাহ করা হয়নি। এ ছাড়া মাঠ ভরাটও হয়নি। এতে নতুন ছাত্রী হল চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে অধ্যক্ষের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, নির্মাণকাজ অসমাপ্ত নেই। কলেজ প্রশাসন ইচ্ছা করলে অনেক আগেই ছাত্রী হল চালু করতে পারত।

গত বুধবার দুপুরে এই হলে গিয়ে দেখা গেছে, নতুন হলের কক্ষে আসবাব থেকে শুরু করে সবকিছুই প্রস্তুত আছে, নেই ছাত্রীরা। ছাত্রী হলের একাধিক কক্ষে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন একাধিক কর্মচারী। এর মধ্যে বুধবার পরিবার নিয়ে সংসার পেতেছেন কলেজ মসজিদের মুয়াজ্জিন জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এত দিন পরিবারসহ শহীদ তিতুমীর আবাসিক হলে থাকতাম। আজ (বুধবার) ছাত্রীদের নতুন হলে উঠেছি।’

যদিও হলে আসন নেই বলে ভোগান্তিতে রয়েছেন ছাত্রীরা। এই কলেজের ছাত্রী জেইন গুলশান বলেন, বেগম রোকেয়া হলে সিট না পেয়ে পাশে কামারগাড়ি এলাকার একটি মেসে থেকে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। এতে থাকা-খাওয়াসহ তাঁর খরচ হয় গড়ে চার হাজার টাকা। আবাসিক হলে থাকতে পারলে এই খরচ দেড় হাজার টাকায় নেমে আসত।

১৩ বছর ধরে বন্ধ তিন হল

ছাত্রীদের নতুন হলটিসহ আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল রয়েছে ছয়টি। এর মধ্যে মেয়েদের জন্য বেগম রোকেয়া হল চালু রয়েছে। আর চালু রয়েছে ফখরুদ্দিন আহমদ হল। এই হলে থাকে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা। আর শের-ই-বাংলা হল, শহীদ তিতুমীর হল ও শহীদ আকতার আলী মুন হল বন্ধ ২০০৯ সাল থেকে। ওই বছর ২০ ডিসেম্বর ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের পর হল তিনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এগুলো আর চালু করা হয়নি।

এর মধ্যে আকতার আলী মুন হলে ৯৬টি, শহীদ তিতুমীর হলে ৮০ ও শের-ই-বাংলা হলে আসন ৪০টি। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় এসব হলের আসবাব থেকে শুরু করে দরজা-জানালা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, পানির লাইনসহ সব মালামাল চুরি হয়ে গেছে।

এর মধ্যে শের-ই-বাংলা হল পরিত্যক্ত ঘোষণা করে অন্য দুটি হল সংস্কার করে তা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আকতার আলী মুন হল ও শহীদ তিতুমীর হল সংস্কারে কয়েক দফায় প্রায় ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। শহীদ তিতুমীর হলের সংস্কার শেষ হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে। ২০১৬ সালে সংস্কার শেষ হয়েছে আকতার আলী মুন হলের। তবে এসব হল চালুর উদ্যোগ নেই কলেজ প্রশাসনের।

বুধবার দুপুরে আকতার আলী মুন হলে গিয়ে দেখা গেল, কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবনের নিরাপত্তাকর্মী জাহাঙ্গীর হোসেন সেখানে পরিবার নিয়ে থাকেন। প্রায় দুই বছর ধরে সেখানে থাকেন তিনি।

শহীদ তিতুমীর হলে গিয়ে দেখা গেল, নিচতলার একটি কক্ষে ছাগলের খামার। অন্য কক্ষে সংসার গড়েছেন কলেজের ইলেকট্রিশিয়ান আজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, তিনি এক বছর বসবাস করেছেন ছাত্রীদের নতুন হলে। গত মঙ্গলবার ছাত্রী হল ছেড়ে এসে উঠেছেন শহীদ তিতুমীর হলে।

শহীদ তিতুমীর হলের দোতলায় দুটি কক্ষে সংসার গড়েছেন কলেজের আরেক ইলেকট্রিশিয়ান রতন মিয়া। তিনিও প্রায় দুই বছর ধরে পরিবারসহ সেখানে বসবাস করছেন।

জানতে চাইলে সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ শাহজাহান আলী বলেন, শহীদ আকতার আলী মুন হল ও শহীদ তিতুমীর হলের সংস্কারকাজ শেষ হলেও একটি হলের আসবাব সরবরাহ করা হয়নি। আসবাব ও তৈজসপত্র সরবরাহ হলেই আবাসিক হল চালু করা হবে। হলের নিরাপত্তার জন্যই কর্মচারীদের থাকতে দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বগুড়ার সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি ও কবি-প্রাবন্ধিক বজলুল করিম বাহার বলেন, সরকারি আজিজুল হক কলেজের চারটি আবাসিক হল যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে এভাবে অযত্ন–অবহেলায় তালাবদ্ধ থাকাটা কলেজ প্রশাসনের শুধু ব্যর্থতা নয়, সরকারি সম্পদের অপচয়ও। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার স্বার্থেই দ্রুততম সময়ে বন্ধ হল চালু করা দরকার।