ভিজিডি এখন ভিডব্লিউবি, চালু হচ্ছে অফলাইন অ্যাপ

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত দুস্থ মহিলা উন্নয়ন (ভিজিডি) কর্মসূচির নতুন নামকরণ হয়েছে ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (ভিডব্লিউবি)। আগামী বছরের জানুযারি থেকে নতুন নামের কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র নারীরা উপকারভোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত হবেন। তাঁদের আবেদনপ্রক্রিয়াকে সহজ করতে এবার চালু হচ্ছে অফলাইন অ্যাপ। এই অ্যাপের মাধ্যমে হাওর, পাহাড়সহ দুর্গম এলাকায় থাকা মানুষেরা মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট–বিচ্ছিন্ন থাকার সময়ও তালিকাভুক্ত হতে আবেদন করতে পারবেন। প্রথম অবস্থায় ৪৩টি উপজেলায় পাইলট আকারে অফলাইন অ্যাপটি চালু হতে যাচ্ছে।

পুরো জেলায় মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক সমস্যা রয়েছে। ৩৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক একেবারেই নেই। ইন্টারনেট তো আরও পরের বিষয়।
আতিয়া চৌধুরী, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের বান্দরবান জেলার উপপরিচালক

আগামীকাল সোমবার (৭ নভেম্বর) মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরার আনুষ্ঠানিকভাবে এই অ্যাপ উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। এদিকে প্রথমবারের মতো এই কর্মসূচিতে আবেদনের জন্য বাল্যবিবাহ ইস্যু ও প্রত্যাগত অভিবাসী পরিবারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।

ভিডব্লিউবি কর্মসূচির উপপরিচালক শারমিন শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বছর থেকে ভিডব্লিউবি নামে কর্মসূচিটি চালু হবে। দুই বছর মেয়াদের নতুন চক্র ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। চলমান চক্রটি (২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত) শেষ হবে আগামী মাসে।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর জানিয়েছে, ভিডব্লিউবি কর্মসূচিতে উপকারভোগীরা দুই বছর ধরে মাসে ৩০ কেজি চাল সহায়তা পান। চলমান চক্রে সারা দেশে দরিদ্র নারী উপকারভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ ৪০ হাজার। একবার যিনি তালিকাভুক্ত হন, তিনি দুই বছর মেয়াদ শেষ করার পর পরবর্তী চার বছর পর্যন্ত আর তালিকাভুক্ত হতে পারেন না।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর জানিয়েছে, ভিডব্লিউবি কর্মসূচিতে উপকারভোগীরা দুই বছর ধরে মাসে ৩০ কেজি চাল সহায়তা পান। চলমান চক্রে সারা দেশে দরিদ্র নারী উপকারভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ ৪০ হাজার। একবার যিনি তালিকাভুক্ত হন, তিনি দুই বছর মেয়াদ শেষ করার পর পরবর্তী চার বছর পর্যন্ত আর তালিকাভুক্ত হতে পারেন না।
নতুন নামকরণের কারণ

গত ১৬ অক্টোবর ভিডব্লিউবি নামে পরিপত্র অনুমোদন করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে এর আগেই নতুন অর্থবছরের জুলাই থেকে নতুন নাম ভিডব্লিউবি খাতে বাজেট বরাদ্দ হয়।

নাম পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, এ রকম প্রায় একই ধরনের কর্মসূচি একীভূত করে ভিডব্লিউবি নামে করার সুপারিশ করেছিল জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র (এনএসএসএস)। বিশেষ করে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা’টিকে নতুন কর্মসূচিতে একীভূত করার কথা ছিল। তবে সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর দুটি ভাতা একসঙ্গে করার বিষয়ে একমত হতে পারেনি। তাই কর্মসূচিগুলো আলাদাই রাখা হয়েছে। এ ছাড়া এনএসএসএসের সুপারিশ অনুসারে, কর্মক্ষম ও দুস্থ নারীদের জন্য একই ধরনের ছোট ছোট কিছু প্রশিক্ষণ প্রকল্প কমিয়ে ভিডব্লিউবি কর্মসূচিভুক্ত করার কথা ছিল। তবে এ ধরনের প্রকল্পের সংখ্যা না কমানো হলেও নতুন কর্মসূচিতে প্রশিক্ষণ যুক্ত করা হয়েছে, যাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে উপকারভোগী নারীরা আয় করার মতো কাজে যুক্ত হতে পারেন।

নতুন চক্রে ভিডব্লিউবি উপকারভোগীদের চালসহায়তা নেওয়ার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কিছু কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে।

অনলাইনে আবেদন চালুর পর দেখা গেছে, দুর্গম, পাহাড়ি ও হাওর এলাকায় ইন্টারনেট–সংযোগ অনেক সময় থাকে না। আবেদন করতে যেন দুর্ভোগ পোহাতে না হয়, সে কারণে অফলাইন অ্যাপ চালু করা হচ্ছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে একজন নারী বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট–বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অ্যাপের মাধ্যমে আবেদন করতে পারবেন। স্মার্টফোনটি ইন্টারনেট–সংযোগে আসামাত্রই আবেদনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনলাইনে জমা হয়ে যাবে।

নতুন কর্মসূচিতে আছে ৩ শর্ত

নতুন কর্মসূচির পরিপত্রে নতুন তিনটি শর্ত যুক্ত হয়েছে, আগে শর্ত ছিল উপকারভোগী নারীদের অঙ্গীকার করতে হবে পরিবারের মেয়েটিকে বাল্যবিবাহ দেবেন না। এবার এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, অঙ্গীকার পূরণ না করলে উপকারভোগীর তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। আরও দুটি শর্তের মধ্যে রয়েছে, যে পরিবারে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী অবিবাহিত মেয়ে রয়েছে, সেই পরিবার এবং প্রত্যাগত অভিবাসী পরিবার উপকারভোগী হিসেবে অগ্রাধিকার পাবে।  

অ্যাপে আবেদন

২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ভিডব্লিউবি কর্মসূচির জন্য তালিকাভুক্ত হতে অনলাইনে (ওয়েবসাইট) আবেদন নেওয়া শুরু হয়। অ্যাপের বিষয়ে ভিডব্লিউবি কর্মসূচির উপপরিচালক শারমিন শাহীন বলেন, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে উপকারভোগীরা আবেদন করতে পারেন। অনলাইনে আবেদন চালুর পর দেখা গেছে, দুর্গম, পাহাড়ি ও হাওর এলাকায় ইন্টারনেট–সংযোগ অনেক সময় থাকে না। আবেদন করতে যেন দুর্ভোগ পোহাতে না হয়, সে কারণে অফলাইন অ্যাপ চালু করা হচ্ছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে একজন নারী বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট–বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অ্যাপের মাধ্যমে আবেদন করতে পারবেন। স্মার্টফোনটি ইন্টারনেট সংযোগে আসামাত্রই আবেদনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনলাইনে জমা হয়ে যাবে।

৪৩টি পার্বত্য, হাওর ও দুর্গম উপজেলায় পাইলট আকারে অফলাইনে আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। উপজেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে বান্দরবানের ৬টি, রাঙামাটির ৮টি, খাগড়াছড়ির ৮টি, কক্সবাজারের ৫টি, সুনামগঞ্জের ১০টি, নোয়াখালীর হাতিয়া, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ এবং নেত্রকোনার দুর্গাপুর, কমলাকান্দা ও খালিয়াজুড়ী উপজেলা।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের বান্দরবান জেলার উপপরিচালক আতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পুরো জেলায় মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক সমস্যা রয়েছে। ৩৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক একেবারেই নেই। ইন্টারনেট তো আরও পরের বিষয়। এর আগে ওই সব এলাকার উপকারভোগীর তালিকা নিয়ে সদরে এসে আবেদন করতে হয়েছে। অফলাইন অ্যাপ চালু হওয়ায় এই সমস্যা দূর হবে। তিনি জানান, দরিদ্র নারীদের অনলাইনে আবেদন করার বিষয়ে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি সহায়তা করে। এ ছাড়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার ও মহিলা সংস্থার ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের মাধ্যমেও আবেদন করে দেওয়া হয়। ভিডব্লিউবি কর্মসূচির চলমান চক্রে বান্দরবানের উপকারভোগীর সংখ্যা ১৫ হাজার ৮৯ জন।

ডিজিটাল পদ্ধতিতে আবেদনের জন্য ২০২৩ সাল থেকে ওয়েবসাইটের পাশাপাশি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। অ্যাপটি গুগল প্লে স্টোরে ‘VWB' নামে পাওয়া যাবে। ওয়েবসাইট ও অ্যাপ তৈরিসহ কারিগরি ও প্রচারে সহায়তা করেছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। ২০১৯ সালে এনএসএসএসের মধ্যমেয়াদি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোতে তালিকাভুক্তিতে ৪৬ শতাংশ ভুল হয়ে থাকে। অর্থাৎ সঠিক ব্যক্তিটি উপকারভোগী হিসেবে নির্বাচিত হন না।

ফলে যথাযথ উপকারভোগী নির্বাচনে অনলাইনে নিজে নিবন্ধন করা, তালিকাভুক্তির জন্য ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) করা, অনলাইনে উপকারভোগীদের ডেটাবেজ করা এবং নিজে নিবন্ধন করার জন্য ৬টি আঞ্চলিক ভাষায় জিংগেল, ভিডিও ক্লিপ প্রচারের ব্যবস্থা নিয়েছে ডব্লিউএফপি।

এ ব্যাপারে ডব্লিউএফপির আবাসিক প্রতিনিধি এবং কান্ট্রি ডিরেক্টর ডমেনিকো স্ক্যালপেল্লি প্রথম আলোর ই–মেইলের জবাবে জানিয়েছেন, দরিদ্র ও দুস্থ নারী ও শিশুদের খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতের জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ২০ বছর ধরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছে। কাজগুলো করা হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র এবং ডব্লিউএফপির নিজস্ব পরিকল্পনার আলোকে। কর্মসূচিগুলোর উপকারভোগী নির্বাচন, পর্যবেক্ষণ, পুষ্টি ও জীবনদক্ষতাবিষয়ক প্রশিক্ষণগুলোতে দক্ষতা আনতে নতুন নতুন অনেক পদ্ধতি সফলতার সঙ্গে প্রয়োগ করেছে ডব্লিউএফপি। ভিডব্লিউবি কর্মসূচি নামে নতুন কর্মসূচিতে ১০ লাখের বেশি উপকারভোগী নির্বাচনে ডব্লিউএফপি সহায়তা অব্যাহত রাখতে চায়।