বন্ধু, কী খবর বল

একসময় সবাই পড়তেন বিকেএসপিতে। অনেক দিন বাদে আবার দেখা, তাই সেলফি তো তোলা চাই! ছবি: শামসুল হক
একসময় সবাই পড়তেন বিকেএসপিতে। অনেক দিন বাদে আবার দেখা, তাই সেলফি তো তোলা চাই! ছবি: শামসুল হক
১২ সেপ্টেম্বর সাভারের বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) হয়ে গেল শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী। সেই মিলনমেলায় ছিলেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, ফুটবলার মামুনুল ইসলাম থেকে শুরু করে শু্যটার আসিফ হোসেন খানদের মতো তারকারা। স্মৃতির ডানায় ভর করে সবাই যেন ফিরে গিয়েছিলেন ছাত্রজীবনে। হইহুল্লোড় আর দুষ্টুমিতে বারবার ফিরে আসছিল গত হয়ে যাওয়া সব আড্ডার টুকরো টুকরো গল্প। সেসবই উঠে এসেছে এবারের মূল রচনায়।
সাকিবের প্রথম গোল, মুশফিকুর রহিমের উচ্ছ্বাস। ছবি: প্রথম আলো
সাকিবের প্রথম গোল, মুশফিকুর রহিমের উচ্ছ্বাস। ছবি: প্রথম আলো

‘হঠাৎ রাস্তায় আপিস অঞ্চলে
হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে
বন্ধু, কী খবর বল?
কত দিন দেখা হয়নি...’
কবীর সুমনের গানের মতোই যেন হারিয়ে ফেলা মুখগুলো দেখে চমকে উঠেছিলেন ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসানরা। দিনটি ছিল ১২ সেপ্টেম্বর। বিকেএসপির শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী। সেদিন সকাল থেকে ছায়াঢাকা শান্ত বিকেএসপি মুখরিত হয়ে উঠেছিল সাবেকদের আনাগোনায়। সঙ্গে ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাংসদ নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
স্মৃতির ডানায় ভর করে সবাই যেন ফিরে গিয়েছিলেন ছাত্রজীবনে। হইহুল্লোড় আর দুষ্টুমিতে বারবার ফিরে আসছিল গত হয়ে যাওয়া সব আড্ডার টুকরো টুকরো গল্প।

সেলফি শিকা​িরদের কবলে মুশফিক!
সেলফি শিকা​িরদের কবলে মুশফিক!

বেয়াড়া টাট্টুর মতো সময় ঠিকই বয়ে যায়। কিন্তু পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে এসে পেছনের সময়গুলো ফিরিয়ে আনতে চাইছিলেন সবাই। এ যেন ক্রীড়াঙ্গনের মহা মিলনমেলা। সেদিনের সেই প্রাণের মেলায় সাকিব-মুশফিক তো ছিলেনই, এসেছিলেন সাবেক ক্রিকেটার নাঈমুর রহমান দুর্জয়, বর্তমানের আবদুর রাজ্জাক, নাসির হোসেন, সৌম্য সরকার, এনামুল হক বিজয়, লিটন কুমার দাস।
বিকেএসপিতে ঢুকতেই গাছের ছায়ায় আড্ডা দিতে দেখা গেল সাবেক ফুটবলার ফিরোজ মাহমুদ টিটু, মাসুদ রানা, মনোয়ার হোসেন, কিংশুক চাকমাদের। আনন্দ শোভাযাত্রার শুরুর মুহূর্তে যোগ দিলেন হাসান আল মামুন এবং জাতীয় ফুটবল দলের বর্তমান অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম।

ছেলেকে নিয়ে হাজির শু্যটার আসিফ
ছেলেকে নিয়ে হাজির শু্যটার আসিফ

ক্যাফেটেরিয়ার সামনে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হকির সাবেক অধিনায়ক মামুনুর রশীদ, মাহবুব এহসান রানা, খেলোয়াড় আবদুস সাজ্জাদ, মওদুদুর রহমান। ১১ মাসের ছেলে আলি বিন আসিফকে নিয়ে মোটরসাইকেলে ঘুরছিলেন কমনওয়েলথ গেমসে সোনাজয়ী শু্যটার আসিফ হোসেন খান। বাস্কেটবলের মিথুন সরকার, শোয়েব হোসেনরা দুষ্টুমি আর খুনসুটিতে মেতে উঠলেন। বন্ধুদের পেয়ে খানিক সময়ের জন্য হলেও যেন স্ত্রী সাদিয়া ইসলামকে ভুলে গেলেন ফুটবলার মামুনুল! মিলনায়তনে অনুষ্ঠান শুরুর আগে ২২ গজের মতোই জুটি বেঁধে সৌম্য আর বিজয় বিক্রি করতে শুরু করলেন র্যাফল ড্রয়ের টিকিট। টিকিট বিক্রি হলো দেদার! তবে বিকেএসপিতে পড়েছেন, এখন তারকা—এমন নারী ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের দেখা মিললই না সেদিন। তাই খানিকটা অপূর্ণতা তো থেকেই গেল!

প্রিয় দুই শিক্ষক কাওসার আলী ও হারুনুর রশীদের সঙ্গে মামুনুল ও নাসির
প্রিয় দুই শিক্ষক কাওসার আলী ও হারুনুর রশীদের সঙ্গে মামুনুল ও নাসির

বিকেএসপিতে পা রেখেই মামুনুলের মনে পড়ল রুশো স্যারের বেতের বাড়ির কথা, ‘রুশো স্যার খুবই কড়া শাসন করতেন। এক দিন বৃষ্টির মধ্যে ছাদে ফুটবল খেলছিলাম। ওই সময় স্যার বেত নিয়ে তাড়া করেন। স্যারকে বলি বেতের বাড়ি না মেরে ফ্রন্ট রোলের (ডিগবাজি) শাস্তি দিতে। সেদিন ১০০টা ফ্রন্ট রোল দিয়ে তবেই মাফ পাই।’
পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের সব আলো কেড়ে নিয়েছিলেন ক্রিকেটাররা। যেখানেই যান মুশফিক-সাকিব, পেছনে মৌমাছির মতো ছোটে সবাই। কে কার আগে সেলফি তুলবে, তা নিয়েই চলে প্রতিযোগিতা।
সাকিব বিকেএসপিতে এসেই ছুটলেন নিজের হোস্টেলের দিকে। বাংলার শিক্ষক শামীমুজ্জামানের সঙ্গে গেলেন নিজের কক্ষে। ব্যাচমেটদের অনেকে সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁদের দেখে বললেন, ‘তোরা এত কম এসেছিস কেন? আর সবাই কোথায়?’

ক্রিকেটার আবদুর রাজ্জাক (বাঁয়ে), সঙ্গে ফুটবলার হাসান আল মামুন ও  ফিরোজ মাহমুদ টিটু ,স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে জাতীয় হকি দলের সাবেক অধিনায়ক মামুনুর রশীদ, সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের কথাগুলো যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন সাকিব আল হাসান
ক্রিকেটার আবদুর রাজ্জাক (বাঁয়ে), সঙ্গে ফুটবলার হাসান আল মামুন ও ফিরোজ মাহমুদ টিটু ,স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে জাতীয় হকি দলের সাবেক অধিনায়ক মামুনুর রশীদ, সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের কথাগুলো যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন সাকিব আল হাসান

সেদিন সবাই স্মৃতির ঝাঁপি মেলে ধরেছিলেন। বিকেএসপির প্রথম দিনের স্মৃতি কখনোই ভুলবেন না বিজয়, ‘সেদিন কয়েক বন্ধু দেরি করে এসেছিলাম। এ জন্য স্যার আমাকে ফ্রন্ট রোল দিতে বললেন। আমি তো বুঝিনি কীভাবে দেব। পরে বুঝলাম ডিগবাজি দিতে হবে।’
বিকেএসপির ছাত্রদের সবচেয়ে মজার ঘটনা চারতলা থেকে অন্যদের গায়ে পানি ছিটানো। ক্লাসে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, দেয়াল টপকে ফুচকা খেতে যাওয়া—এসব মনে পড়তেই রোমাঞ্চ ছুঁয়ে যাচ্ছিল সবার মনে। ক্রিকেটার আবদুর রাজ্জাক বলছিলেন, ‘আমরা এত শাস্তি পেয়েছি যে সেটা এখন বলা শুরু করলে ছয় বছর লেগে যাবে।’

পুনর্মিলনীর নিবন্ধনে সৌম্য সরকার
পুনর্মিলনীর নিবন্ধনে সৌম্য সরকার

ছাত্ররা কে কেমন ছিলেন তা নিয়ে স্মৃতিচারণা করলেন মুশফিকদের প্রিয় শিক্ষক শামীমুজ্জামান, ‘মুশফিক ক্লাসে সব সময় প্রথম বেঞ্চে বসত। ওর হাতের লেখা খুবই চমৎকার। পরীক্ষার খাতায় কোনো কাটাকাটি থাকত না। গোটা গোটা অক্ষরে লিখত।’ পড়াশোনায় কেমন মনোযোগী ছিলেন মুশফিক, সেটাও বললেন শামীমুজ্জামান, ‘মুশফিক ক্লাসে সর্বোচ্চ নম্বর পেত। উচ্চমাধ্যমিকে এ প্লাস পাওয়া বিকেএসপির প্রথম ছাত্র ও। মুশফিক যখন দেশের বাইরে যেত, কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম ডাক দিয়ে বলতেন, “ও বিদেশ যাচ্ছে, তুমি ওর জন্য সাজেশন নিয়ে এসো। বিদেশে গিয়েও নিয়মিত পড়ত মুশফিক।”’
সাকিবের প্রসঙ্গ আসতেই বললেন, ‘ক্লাসে খুবই বিনয়ী ছিল সাকিব। একদম চুপচাপ থাকত। কোনো কথা বলত না। মাঝে মাঝে খেলার জন্য স্কুল কামাই হতো ওর। কিন্তু এরপর যখন ক্লাসে আসত, তখন ওর বন্ধুরা বলত, “স্যার সাকিব এসেছে।” বন্ধুরা ওকে নিয়ে খুব উচ্ছ্বাস দেখালে মিটমিট করে হাসত সাকিব।’
শু্যটার আসিফের হাতের লেখা নাকি খুবই ছোট ছোট ছিল। শামীমুজ্জামান বলছিলেন, ‘হাতের লেখার জন্য সব স্যারই ওকে বকা দিত। বলত, এটা কি মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হবে? তবে আসিফ খুব ভালো ছবি আঁকত, উপস্থাপনা করত।’

পুনর্মিলনীর শুরুতে শোভাযাত্রা
পুনর্মিলনীর শুরুতে শোভাযাত্রা

বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের ফুটবল ম্যানেজার ফিরোজ মাহমুদ টিটু যেন এই দিনটির অপেক্ষায়ই ছিলেন, ‘খেলোয়াড়দের নিয়ে মাঝেমধ্যে বিকেএসপিতে ক্যাম্পে বা খেলতে আসি। কিন্তু এখানে এলেই বন্ধুদের জন্য মনটা হাহাকার করত। কত কথা মনে পড়ত। বিকেএসপির প্রতিটি ইট-ঘাসে স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই অনুষ্ঠানে এসে ব্যাচমেট, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলো। কী যে ভালো লাগছে, বলে বোঝাতে পারব না।’
সময় যায় সময়ের পথ ধরে। নাচ, গান, কনসার্ট, শোভাযাত্রা আর ফুটবল ম্যাচ খেলে ক্লান্ত সাকিবরা যখন রাতে গন্তব্যে ফিরছিলেন, নিশ্চয় মনে পড়ছিল সেই গানের কলি, ‘...একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি, শুধু সেই সেদিনের মালি নেই...।’

আরও পড়ুন: