মা, আমি আসছি

ছোটবেলায় আমার খুব আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছা হতো। রাতে প্রায়ই স্বপ্ন দেখতাম, মেঘের পিঠে চড়ে তারাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছি। পূূর্ণিমার গোল গাল চাঁদটাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছি। মাকে বলতাম, ‘মা, আমি আকাশ ছোঁব।’ মা বলত, ‘অনেক বড় হলে আকাশ ছোঁয়া যায়।’ ভাবতাম, বাড়ির সামনের তালগাছটার চূড়ায় উঠতে পারলেই হয়তো আকাশ ছোঁয়া যাবে!

আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়েই বড় হতে থাকি। বড় হওয়ার জন্যই আমার শিক্ষিত মা আমাকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেন। দাদু-দিদার সংসারে মামা-মাসিদের আদরে আমাকে মায়ের অভাব ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করা হতো। বালিশভেজা কান্নায় এক-একটি রাত পার করতাম। ভাবতাম, আট বছরের ছোট্ট বাবুটিকে ছেড়ে নির্দয় মহিলাটি থাকে কীভাবে? মাকে ভুলে থাকার বৃথা চেষ্টা করতাম।

নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় মাকে রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পটি পড়তে বলেছিলাম। মা বলেছিল, ‘তোমার অবস্থানটি ফটিকের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ।’ মাকে আমি কখনোই বোঝাতে পারিনি তাঁর জন্য আমার মনটি কেমন করে কাঁদে! নাকি মা বুঝেও না বোঝার ভান করতেন?

আমার এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর মা খুব কেঁদেছিলেন। ভাবতেই অবাক লাগল, আমার সাফল্যে নির্দয় মহিলাটি এমন করে কাঁদতে পারে! এরপর আমার এক-একটি সাফল্য মায়ের চোখে আনন্দাশ্রু ঝরায়। আর আমার ব্যর্থতাগুলোতে মা নাকি সাফল্যের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। আমার চোখে জল দেখে মা বলেন, ‘সৎভাবে এগিয়ে যাও, সাফল্য আসবেই।’ মা আমাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন।

এখন আমি একা থাকি। তাই তো মায়ের যত চিন্তা! আমি ঠিকমতো খাচ্ছি কি না, পড়ছি কি না, বাজে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশি কি না, এসব মায়ের জানা চাই। মা ভাবেন, আমি এখনো সেই ছোট্ট বাবুটি রয়ে গেছি। যেন ভুল করেই ভুল জায়গায় পা দেব। ছুটিতে বাড়ি গেলে মা ছাড়তে চান না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আরও কিছুদিন থাকতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ব্যস্ততা আমাকে মায়ের কাছে বেশি দিন থাকতে দেয় না। মা হয়তো ভাবেন, দূরে থাকতে থাকতে তাঁর ছেলেটি কেমন দূরে সরে গেছে!

নাগরিক ব্যস্ততায় কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে উঠেছি। মায়ের সঙ্গে কথা বলার ফুরসতটুকু পাই না। বালিশ না ভিজলেও বুকফাটা কান্নায় এখনো মায়ের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে। সেই ছোট্ট বাবুটি হয়ে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে মা চাঁদমামাকে আমার কপালে টিপ দিতে বলবেন। আর আমি ঘুম ঘুম চোখে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে বিভোর হব।

শুভাশীষ শর্মা

চট্টগ্রাম।