আমরা কি আরও মানবিক হতে পারি না

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাস নিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য অমানবিক গল্প পড়ি পত্রিকায়। করোনায় আক্রান্ত নিজের মা কে জঙ্গলে রেখে আসা, মৃত বাবা কে হসপিটালে রেখে ছেলেদের পলায়ণ, নিজের স্ত্রী বা বোনকে বাড়িতে জায়গা না দেওয়াসহ এরকম অসংখ্য অমানবিক ঘটনা আমাদের সমাজে ঘটে যাচ্ছে।

আমরা এরকমও দেখেছি নিজের স্বামী/বাবা'র করোনা হয়েছে সন্দেহ করে তাকে ঘরে তালা দিয়ে পরিবারের সবাই মার্কেটে চলে গেছে। আর সেই বাবা/স্বামী পানির তেষ্টা মেটানোর যন্ত্রণা পেতে পেতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। করোনাভাইরাস যখন মানুষের জীবন নিয়ে খেলছে তখন চারপাশের কিছু অমানবিক মানুষের পশুরূপ দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারছিনা।

একবার ভাবুন তো, যে বাবা আপনাকে মানুষ করলো গায়ের ঘাম ঝরিয়ে/ যে মা দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে আপনাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসলো তারা কি আপনার এই ধরণের আচরণ প্রত্যাশা করেছিল? আপনাকে মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে নিয়ে আসা কি তাদের অপরাধ? এরপরে যদি আপনার ছেলে/মেয়ে আপনার সাথে একই রকম আচরণ করে তখন আপনার কেমন লাগবে?

শুধু তাই নয়, ক্ষুদ্র পরিবার ছাড়িয়ে সমাজও একই আচরণ করছে আমাদের বাংলাদেশে। করোনায় মারা যাওয়া মানুষকে কবর দিতে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে, পাশের ফ্লাটে আক্রান্ত মানুষকে একঘরে করে রাখা হচ্ছে, বাসা ছেড়ে দিতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এমনকি নার্স-ডাক্তার যারা জীবন বাজি রেখে চিকিত্সা সেবা দিচ্ছে তাদেরও ঘর ছাড়তে বলা হচ্ছে।

যারা এরকম করছেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন করোনায় আক্রান্ত মানুষ কি চোর, বাটপার নাকি তারা দাগী আসামী? সমাজের যারা প্রকৃত অপরাধী আপনার পাশের ফ্লাটে টাকার গরম দেখায় তাদের তো আপনি কিছু বলতে পারেন না। আপনার যত সমস্যা একজন অসহায় মানুষ কে নিয়ে। কারন একটাই অসহায় মানুষকে অত্যাচার করা সহজ।

আপনাকে তো বলা হয়নি আপনি সাহায্য করেন। আপনি বেশী ভীতু হলে আপনারই দূরে চলা যাওয়া উচিত। সাহায্য করতে না পারেন, আপনি মানবিক হোন। আর আপনি কি বলতে পারেন আগামীকাল আপনি আক্রান্ত হবেন না? আপনার কিসের এত বড়াই বলতে পারেন? এটা মনে রাখা উচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ উঁচুনিচু ভেদাভেদ করে না।
অবশ্যই করোনাভাইরাস নিয়ে সবার শংকা থাকবে। আপনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে আপনার মত সতর্ক থাকুন। সাবধানে থাকা আর অমানবিক হওয়া এক জিনিস নয়। আচ্ছা একবার পুলিশ-ডাক্তার-নার্সসহ ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা মানুষদের কথা চিন্তা করুন। আপনার জানা উচিত তাদের সন্তান আছে, পরিবার আছে। তারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে আপনার সেবা দিচ্ছেন। আর আপনি শুধু মানবিক হতে পারছেন না। আপনাকে কি তবে মানুষ বলা যায়?

গত কয়েকদিন ধরে এই একটা জিনিসই মনে হচ্ছে: আমাদের মানবিকতার বড় অভাব। বলছি না সবার অভাব। কিন্তু যারা করছে তারা কেন করবে? তারা কি বেশী ভিতু/ নাকি বেশী অমানবিক ভাবছি। যারা বেশী ভিতু তাদের জন্য বলছি পাশের ফ্লাটে/বাড়িতে করোনা রোগী থাকলে তাদের তাদের মতো থাকতে দিন। এখন তো মোবাইল আছে/ ফেসবুক আছে। তাদের আপনার জানা থাকা পরামর্শ দিন। আপনি তাদের সাহস দেন। আর আপনিও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাবধানে থাকেন। আর করোনা রোগে আক্রান্ত পরিবারের মেডিকেশন/ বাজার করবার দরকার সামাজিক দূরত্ব বজায রেখে তাদেরকে সহায়তা করুন। আপনার খারাপ কিছু হবে না। বরং ভাল হবে। যারা সত্যি অমানবিক তাদের জন্য বলার কিছু নাই। শুধু বলব মানবিক হওয়ার আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করুন।

আমার মনে হয় সামাজিক ভীতি দূর করবার জন্য জনগনের মাঝে আরও বেশী সচেতনতা তৈরী করা দরকার। সরকারের উচিত ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া ব্যবহার করে জনগনকে আরও বেশী সচেতন করা। সরকারের পাশাপাশি সামাজিক প্রচষ্টা কোন মহামারী মোকাবিলা করতে খুবই জরুরী। দু:খজনক হলেও সত্যি যে সামাজিক মূল্যবোধের পরিস্কার অবক্ষয় এখন আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

*পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র