কোনো বাজারই কিন্তু কারসাজিমুক্ত নয়

>

শাকিল রিজভী।
শাকিল রিজভী।

শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী। সাম্প্রতিক এ উত্থানে তালিকাভুক্ত দুর্বল কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বাজারের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজয় মহাজন

প্রথম আলো: শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক সময়ে উত্থানকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

শাকিল রিজভী: বাজারের সাম্প্রতিক উত্থানকে মূল্যায়ন করতে হলে বিগত কয়েক বছরের বাজারের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। ওই সময় বাজারে মন্দাভাব থাকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনেকে আতঙ্কে ও অধৈর্য হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। আর অল্প অল্প করে কিছুসংখ্যক সম্ভাবনাময় বিনিয়োগকারী তা কিনে নেন। একপর্যায়ে এসে বাজারে আতঙ্কিত বিক্রির চাপ একেবারে কমে যায়। এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকে আমানতের সুদ হারও কমে গেছে। এতে করে কিছু কিছু অর্থ শেয়ারবাজারে আসতে থাকে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশেও একধরনের স্থিতিশীলতা আসে। তাই একপর্যায়ে গিয়ে শেয়ারের দাম বাড়তে শুরু করে। তখন অনেকে আবার বাজারে যুক্ত হন। আর তাতেই বাজারে গতিসঞ্চার হয়েছে। শেয়ারের দামের বিবেচনায় যে বৃদ্ধি ঘটেছে, সেটিকে আমার স্বাভাবিক ও যৌক্তিক বলে মনে হয়। তবে বৃদ্ধির ধরনকে অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে ভালো মনে হয়নি।

প্রথম আলো: আপনি বলছিলেন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনেকে আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দেন। আবার দাম বাড়তে থাকলে তাঁরাই বাজারে ফিরে আসেন। এটি কেন ঘটে?

শাকিল রিজভী: আমাদের বাজারের এ এক অদ্ভুত চরিত্র। বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী বাজারমুখী হন দাম বাড়তে থাকলে। এটি ঘটে মূলত দ্রুত ও রাতারাতি লাভের প্রত্যাশার কারণে। এ কারণে বেশির ভাগ সাধারণ বিনিয়োগকারী শেয়ারের দাম কম থাকলে তখন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখান না। তাঁরা মনে করেন, টাকা খাটিয়ে বসে থেকে কী লাভ। তাই দাম বাড়তে থাকলে তাঁরা দ্রুত টাকা বানানোর প্রত্যাশা থেকে বাজারমুখী হন।

প্রথম আলো: আপনারা সব সময় পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগের পরামর্শ দেন। তা সত্ত্বেও কেন দ্রুত ও রাতারাতি মুনাফা করার এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না।

শাকিল রিজভী: এটির বড় কারণ হলো আমাদের বাজারের গভীরতা কম। ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে বছর শেষে ভালো লভ্যাংশ পাবেন এমন কোম্পানির সংখ্যা কম। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনিয়োগের আগ্রহ গড়ে উঠছে না। যদি বাজারে গভীরতা ও ভালো ভালো কোম্পানি বেশি থাকত, তাহলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগের প্রবণতা তৈরি হতো। ভালো কোম্পানির অভাবে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণটাকে আমরা বিনিয়োগমুখী করতে পারছি না।

প্রথম আলো: ভালো কোম্পানির সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হলেও সেটি হচ্ছে না কেন?

শাকিল রিজভী: বাজারে ভালো কোম্পানির সংখ্যা বাড়াতে হলে যেমন উদ্দীপনা দরকার, তেমনি উদ্যোক্তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। অনেক ভালো কোম্পানির উদ্যোক্তারা মনে করেন, বাজারে তালিকাভুক্ত হলে তাঁদের কর্তৃত্ব খর্ব হবে। তাই তাঁরা শেয়ারবাজারের পরিবর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়াকে অগ্রাধিকার দেন। আমাদের দেশে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো দীর্ঘ মেয়াদে পুঁজির জোগান দেয়। অথচ পুঁজিবাজারই হওয়া উচিত দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের মূল জায়গা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ দেশে তা হয়নি।

প্রথম আলো: বাজারের সাম্প্রতিক উত্থানে কিছু দুর্বল বা বাজে কোম্পানির শেয়ারেরও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। সেটি কেন?

শাকিল রিজভী: বাজারে নতুন যেসব বিনিয়োগকারী আসেন, তাঁদের অনেকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোম্পানির গুণমানকে বিবেচনায় নেন না। এমনকি তাঁদের কাছে সেগুলো তেমন একটা গুরুত্বও পায় না। কোম্পানির পারফরম্যান্সের চেয়ে তাঁরা বাজারে শেয়ারের দাম দেখে বিনিয়োগ করেন। যখন তাঁরা দেখেন, কোনো শেয়ার ৮-১০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে, তখন দামের কারণে সেটিকে ভালো মনে করেন। একই সঙ্গে এটাও ভাবেন, অনেকের চেয়ে তিনি কম দামে শেয়ার কিনতে পেরেছেন।

প্রথম আলো: অনেকেই মনে করেন, দুর্বল কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কারসাজির ঘটনা রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?

শাকিল রিজভী: কোনো বাজারই কিন্তু কারসাজিমুক্ত নয়। তবে কারসাজিকে যতটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যায়, বাজারের জন্য তা মঙ্গলজনক।

প্রথম আলো: ২০১০ সালের কেলেঙ্কারির পর স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা আলাদা বা ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়েছে। তাতে কি সুশাসনের কোনো উন্নতি হয়েছে বলে মনে করেন?

শাকিল রিজভী: পুরোপুরি সুশাসন নিশ্চিত হয়েছে এমন দাবি আমি করব না। তবে আগের চেয়ে অনেক বিষয়ে উন্নতি হয়েছে। যদিও উন্নতির আরও অনেক সুযোগ আছে। আগে ব্রোকারেজ হাউস ও গ্রাহকের হিসাবের টাকা একসঙ্গে রাখা হতো। এখন ভিন্ন ভিন্ন হিসাবে রাখা হয়। তবে অনেকের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে, ডিমিউচুয়ালাইজেশন হয়ে গেলে বিনিয়োগকারীরা যে দামেই শেয়ার কিনুন না কেন, তিনি তাতে নিরাপদ। অথচ ডিমিউচুয়ালাইজেশনের সঙ্গে শেয়ারের দামের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কথা ঠিক, ডিমিউচুয়ালাইজেশনের আরও কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। বিশেষ করে, ব্লক হিসাবে রাখা শেয়ার বিক্রির কাজটি এখনো সম্পন্ন হয়নি।