বিচার হয় না চুরির তদন্তে

বাংলাদেশ ব্যাংকে অর্থ চুরির ঘটনা আরও আছে। সেসব ঘটনার তদন্ত হচ্ছে, প্রতিবেদনও জমা পড়ছে। কিন্তু কোনো বিচার হচ্ছে না। ফলে আবারও নতুন করে চুরি হচ্ছে।
২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট থেকে ৫ লাখ টাকা চুরি করেন স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কর্মকর্তা দীপক চন্দ্র দাশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। একটি নয়, দুটি তদন্ত কমিটি কাজ করে মহা নিরাপত্তা এলাকার নিরাপত্তা ত্রুটি ও জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে। এরপর কেটে গেছে ১৫টি মাস।
দুটি তদন্ত রিপোর্টই জমা দেওয়া হয়েছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের চাপে ওই রিপোর্ট গভর্নরের কাছে এখনো উপস্থাপন করা হয়নি। ফলে অধরাই রয়ে গেছেন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ও সহায়তাকারী ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুরির ঘটনার তদন্ত হচ্ছে, সবকিছু জানা যাচ্ছে—কারা দায়ী, কাদের গাফিলতি ছিল—এরপরও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আশ্চর্য হই এসব শুনে। এভাবে দোষীদের আড়ালে রাখলে তো ঝুঁকি বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংককে ভল্ট এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।’
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে কমিটি গঠন করে সরকার। এই কমিটি গত ৩০ মে অর্থমন্ত্রীর কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়। কয়েকবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও প্রকাশ করা হয়নি তদন্ত প্রতিবেদন। এমনকি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। এখন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঘটনার তদন্ত করছে।
সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মো. শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের প্রতিবেদনে কিছু কর্মকর্তার দায়িত্ব অবহেলার তথ্য এসেছে। আমরাও তথ্য পেয়েছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা চুরির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল। তাদের কার্যক্রম হ্যাকারদের চুরিতে সহায়তা করেছে। বিভিন্ন দেশের ২৩ জন এই চুরিতে জড়িত ছিল। তাদের বিষয়ে তথ্য জানতে দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এ ঘটনার মূল হোতা কে দেশগুলো থেকে তথ্য পাওয়ার পরই তা জানা যাবে। ইন্টারপোল, এফবিআই তদন্তে সহায়তা করছে। কবে নাগাদ তদন্তকাজ শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না।’
গত ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ক্যাশ কাউন্টার থেকে ১ লাখ টাকা চুরি করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়েন ইরানের দুই নাগরিক। এ ঘটনারও কোনো বিচার হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, লোকদেখানো তদন্ত কমিটি করা হচ্ছে, কিন্তু কোনো বিচার হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টের ভিডিও ফুটেজও বাইরে সরবরাহ করা হয়েছে, তারও তো কিছু হলো না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভল্টে চুরি হয়নি, ভল্ট এলাকায় চুরি হয়েছিল। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের টাকা অন্য এক ব্যাংকের কর্মকর্তা চুরি করেছিলেন। টাকা ফেরত পাওয়া গেছে, ডাচ-বাংলা ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিতে রাজি হয়নি। এরপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কমিটি করে ঘটনাটির তদন্ত করেছে। প্রয়োজন বোধ করলে নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেবে। তবে তদন্ত রিপোর্টের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’
শুভঙ্কর সাহা আরও বলেন, ‘দুটো চুরির ঘটনার টাকা ফেরত পাওয়া গেছে। উপযুক্ত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। ফলে আরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না জানি না।’
২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ভল্ট এলাকার সিসিটিভিতে ধারণ করা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, বিকেল ৫টা ৭ মিনিট ১৮ সেকেন্ড থেকে ৫টা ৮ মিনিট ৪ সেকেন্ডের মধ্যে এ চুরি সংঘটিত হয়। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দীপক চন্দ্র দাশকে চিহ্নিত করা হয়। এ চুরির ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত না করেই দীপক চন্দ্রকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত রিপোর্ট বিভাগে জমা হয়েছে। এটা নিয়ে কাজ চলছে। এরপরই গভর্নরের কাছে উপস্থাপন করা হবে।