ভালো মানবসম্পদ এই শিক্ষা ব্যবস্থায় তৈরি হচ্ছে না

>

দেশের প্রথম সারির একজন তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উদ্যোক্তা ফাহিম মাশরুর। বাংলাদেশে চাকরিবিষয়ক সবচেয়ে বড় অনলাইন পোর্টাল বিডিজবস ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী তিনি। বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসা, সফটওয়্যার রপ্তানি, ইন্টারনেট সেবার মান ও অবকাঠামো, ফোরজি প্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, ডিজিটাল সেবার সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশরাফুল ইসলাম

প্রথম আলো: বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের বর্তমান অবস্থা কী?

ফাহিম মাশরুর: ই-কমার্স বাংলাদেশে একটি নতুন খাত। বাংলাদেশে এই খাতটি খুবই অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। এখনো প্রচুর ই-কমার্স উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা প্রধানত ফেসবুক বা এ ধরনের সামাজিক মাধ্যমে ব্যবসা করেন। একটা পর্যায়ের পর বড় উদ্যোক্তারা এই ব্যবসায় আসেন, বাংলাদেশে এটা কেবল শুরু হয়েছে।

প্রথম আলো: ই-কমার্সের বাজার এখন কত? এটা কী হারে বাড়ছে?

ফাহিম মাশরুর: ভারত বা চীনে বছরে যত পণ্যসেবা বিক্রি হয়, তার ১ থেকে ২ শতাংশ ই-কমার্সে বিক্রি হয়। বাংলাদেশে মোট পণ্য বিক্রির ১ শতাংশও যদি ই-কমার্সে বিক্রি হয়, তাহলে আগামী পাঁচ বছরে এই বাজার ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে। এখানে ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই বাজারটি এখন মাত্র ৪০০ কোটি টাকার।

প্রথম আলো: স্থানীয় ই-কমার্স খাতের প্রসারে কী করা যেতে পারে?

ফাহিম মাশরুর: ভারত বা চীনের মতো দেশে সরকারের নীতির কারণে স্থানীয় ই-কমার্স খাত বিকশিত হয়েছে। আমরা যদি দেশীয় কোম্পানিগুলোকে সুরক্ষা না দিতে পারি, তাহলে টেলিযোগাযোগ খাতের মতো এই খাতও সম্পূর্ণভাবে বিদেশিদের হাতে চলে যাবে। টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ই-কমার্সে ঢুকতে না পারে, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত দেশীয় পণ্য নিয়েই কাজ করে। এর সঙ্গে দেশের আরও অনেক শিল্প ও সরবরাহকারী জড়িত। এদের আয়ের বড় অংশই দেশে থাকছে, কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এই বাজার স্থানীয় উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে নাকি বিদেশি কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যাবে, সে ব্যাপারে সরকারকে নীতিগত সিদ্ধান্ত দিতে হবে।

প্রথম আলো: ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ ফেসবুকভিত্তিক এফ-কমার্স। দুটি মাধ্যমে ব্যবসার ক্ষেত্রে কী ধরনের পার্থক্য রয়েছে?

ফাহিম মাশরুর: এফ-কমার্সের বড় সমস্যা হলো যে কেউ ফেসবুকের পাতা খুলে পণ্য বিক্রি করতে পারে, এর জন্য কারও অনুমতি নিতে হয় না। কিন্তু ই-কমার্স উদ্যোক্তাকে ট্রেড লাইসেন্সসহ অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। গ্রাহকের অধিকার নিশ্চিতে জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্যসেবা বিক্রির ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো নিয়ম নেই। অনেকের ধারণা, ই-কমার্স ব্যবসা খুব লাভজনক। কিন্তু এখানে ব্যবসা করতে হলে দীর্ঘ মেয়াদে বড় ধরনের বিনিয়োগ লাগে। এই খাতে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগও আছে।

প্রথম আলো: ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করার একটা প্রবণতা এখন দেখা যাচ্ছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

ফাহিম মাশরুর: ইন্টারনেট প্রযুক্তির দর্শনই হলো অন্যের অধিকার লঙ্ঘন না করে সাধারণ মানুষ মুক্তভাবে তাঁর মতামত প্রকাশ করতে পারবে। এ বিষয়টিকে এখন যদি অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে ইন্টারনেট ব্যবহারের মূল দর্শন থেকে সরে আসতে হবে। তখন ইন্টারনেটও স্বাধীন থাকবে না।

প্রথম আলো: এ বছর দেশে ফোরজি প্রযুক্তি চালু করার কথা বলা হচ্ছে। এর ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে কী সুবিধা মানুষ পেতে পারে?

ফাহিম মাশরুর: থ্রিজি দিয়ে সারা দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার একটা পর্যায় পর্যন্ত গেছে। থ্রিজি ইন্টারনেটের বড় সুফল গেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে। কারণ তাঁদের এই সেবা কেনার ক্ষমতা আছে। উচ্চ অবকাঠামোগত ব্যয়ের কারণে এখন মুঠোফোন ইন্টারনেটের যে দাম, সেটা খুব বেশি কমানো সম্ভব নয়। এ জন্য ব্যাপকভাবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করতে হবে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বলতে গ্রামগঞ্জে কেব্‌ল টেনে ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমে ইন্টারনেট দিতে হবে। ওয়াই-ফাই ও ব্রডব্যান্ড ছাড়া থ্রিজি-ফোরজি এলে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে না।

প্রথম আলো: ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে কোন বিষয়গুলোকে আপনি বড় সমস্যা মনে করেন?

ফাহিম মাশরুর: এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো সারা দেশে ইন্টারনেট অবকাঠামোর দুর্বলতা। শহরে ইন্টারনেট অবকাঠামো উন্নত হয়েছে কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে হয়নি। মুঠোফোনভিত্তিক থ্রিজি, ফোরজি দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ এগুলো দিয়ে ন্যূনতম ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ অনেক বেশি। দ্বিতীয় হলো ইন্টারনেটে বাংলা বিষয়বস্তু ও অনলাইন সেবার অভাব। আরেকটা বড় সমস্যা হলো, অনলাইনে অর্থ পরিশোধ কীভাবে করা হবে। মুঠোফোনভিত্তিক আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ই-কমার্স উদ্যোক্তার যোগসূত্র বাড়াতে হবে, যাতে প্রান্তিক পর্যায় থেকে টাকা আনা যায়।

প্রথম আলো: বলা হয়, সফটওয়্যার রপ্তানি বাংলাদেশের পরবর্তী তৈরি পোশাক খাতের জায়গা নিতে পারে। কিন্তু সফটওয়্যার রপ্তানি কেন প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না?

ফাহিম মাশরুর: এটা প্রত্যাশিত হারে না বাড়ার মূল কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এই শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে আমরা খুব ভালো মানের মানবসম্পদ তৈরি করতে পারছি না। এমন ব্যবস্থা দিয়ে আসলে পোশাক খাতের মতো বিলিয়ন ডলারের কোনো শিল্প হবে না। শিক্ষাকে আমরা এত বেশি বাণিজ্যিক করে ফেলেছি যে সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু মান বাড়েনি। এ কারণে বেশ কয়েকটি বহুজাতিক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে অথবা ব্যবসা কমিয়ে ফেলছে।

প্রথম আলো: সফটওয়্যার বা তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিতে তাহলে করণীয় কী?

ফাহিম মাশরুর: সফটওয়্যার রপ্তানি না বাড়লেও আমাদের দেশেই এর একটি বড় বাজার রয়েছে। গত চার-পাঁচ বছরে সরকারি-বেসরকারি খাতে যত সফটওয়্যার কেনা হয়েছে, তার ৯০ শতাংশই হয়েছে বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে। এখানে স্থানীয় কোম্পানিগুলো কাজ করার সুযোগই পায়নি।