বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হিসাবে অসংগতি

গত অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এটি সাময়িক সরকারি হিসাব। তবে সরকারের হিসাবকে ‘অতি প্রাক্কলন’ বা ‘ওভার এস্টিমেটেড’ হিসেবে মন্তব্য করেছে বিশ্বব্যাংক। এর কারণ হিসেবে এই সংস্থাটি বলেছে, বন্যার কারণে কৃষি খাতের ক্ষতি হিসাবে আনা হয়নি। আবার জিডিপি হিসাব করতে পণ্য ও সেবা সৃষ্টির সঙ্গে খরচের ‘পরিসংখ্যানগত অসংগতি’ আছে।

বিশ্বব্যাংকের ‘গ্রোথ আউট অব ব্লু’ শীর্ষক প্রতিবেদনে গত অর্থবছরের প্রবৃদ্ধিকে এভাবেই মূল্যায়ন করা হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কিছু কমে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে। প্রবৃদ্ধি কমার ঝুঁকি হিসেবে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নীতি সংস্কারে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জিডিপি দুভাবে হিসাব করা হয়। একটি হলো দেশের অভ্যন্তরে কী পরিমাণ উৎপাদন হলো; অপরটি হলো সারা বছরে কত খরচ করা হলো। গত অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি হিসাবে এই দুইয়ের মধ্যে অসংগতি আছে। গত বছর যে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, এর মধ্যে ২ দশমিক ০৩ শতাংশে ‘পরিসংখ্যানগত অসংগতি’ আছে।

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, চলতি অর্থবছরের কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি কমার কারণে সার্বিক প্রবৃদ্ধি কমতে পারে। আবার সেবা খাতে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি না–ও হতে পারে। গত দুই অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেড়েছে। কিন্তু প্রতিবছর তো বেতন–ভাতা এভাবে বৃদ্ধি পাবে না। তাই সেবায় প্রবৃদ্ধি আগের মতো হবে না। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতি অস্থিতিশীল হতে পারে, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ভালো প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করছে। চলতি অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আবার নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের অভ্যন্তরেও পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হতে পারে। বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, শিল্প উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং সেবা খাতের উৎকর্ষ থাকবে। দুর্বল রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, আমদানি বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে চলতি হিসাবে ঘাটতি বড় আকার ধারণ করবে। এ ছাড়া আর্থিক খাতের দুর্দিনও চলমান থাকবে।

অর্থনীতির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলেছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে পারে। অন্য ঝুঁকিগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে রপ্তানি কমে যাওয়া, রেমিট্যান্স প্রবাহে দুর্বলতা ও ব্যাংক খাতে করপোরেট সুশাসনের অভাব। এমনকি অতিরিক্ত তারল্যও অর্থনীতির জন্য একধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হলেও বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশে রাখা যাবে; যদি বাস্তবায়ন না করে খরচ কমানো হয়। সরকার কোন কোন খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খরচ করবে, তা নির্ধারণ করা জরুরি। বাজেটে রাজস্ব ও মূলধনি খরচের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বেশ উচ্চাভিলাষী। কেননা, লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হয় না, আবার খরচও হয় না। এতে উভয় খাতই পরস্পরকে সহায়তা করছে। এর ফলে সরকারের বাজেট প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধির সুযোগ আছে। বাজেটে বিদেশি ঋণের দায় জিডিপির ৪ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য রয়েছে। এটি আসলে নির্ভর করবে কী পরিমাণ রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হবে। কিন্তু নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন দুই বছরের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই আইন হলে রাজস্ব আদায়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল।

বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সংস্কার খুবই জরুরি। কিন্তু নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন ও ব্যাংক কোম্পানি আইনের ক্ষেত্রে উল্টো হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি ভোগ কমে ৪ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে। গত অর্থবছরে এটি ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মানে হলো, জনগণের মধ্যে খরচের প্রবণতা কমবে। একইভাবে সরকারি ভোগ কমে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হবে। সার্বিকভাবে বছরের গড় মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। গত অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।