কৃষকেরা তো ঠকছেনই, ঠকছেন ভোক্তারাও

পাইকারি থেকে খুচরা বাজারে যেতেই সবজির দাম দুই থেকে চার গুণ বেড়ে যাচ্ছে। বগুড়ার সবজির মোকাম মহাস্থান হাটে প্রতি কেজি ফুলকপি ৮ টাকায় বিক্রি করছেন কৃষকেরা। সেই বাজারেই খুচরায় ফুলকপি কিনতে হয় প্রতি কেজি ২৪ টাকায় l সোয়েল রানা
পাইকারি থেকে খুচরা বাজারে যেতেই সবজির দাম দুই থেকে চার গুণ বেড়ে যাচ্ছে। বগুড়ার সবজির মোকাম মহাস্থান হাটে প্রতি কেজি ফুলকপি ৮ টাকায় বিক্রি করছেন কৃষকেরা। সেই বাজারেই খুচরায় ফুলকপি কিনতে হয় প্রতি কেজি ২৪ টাকায় l সোয়েল রানা

শীতের সবজির ভালো আবাদ হয়েছে এবার। বিভিন্ন এলাকার পাইকারি হাটবাজারে প্রতিদিনই প্রচুর পরিমাণ সবজি বিক্রির জন্য নিয়ে আসছেন কৃষকেরা। সরবরাহ বেশি থাকায় কৃষকদের কম দামে সবজি বিক্রি করতে বাধ্য করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে অনেক কৃষক লোকসানও গুনছেন। তবে সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ ভোক্তারা। দুই থেকে চার গুণ বেশি দামে শীতের সবজি কিনতে হচ্ছে তাঁদের। শেষ পর্যন্ত লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরাই। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহর, এমনকি গ্রামেও একই চিত্র।

শীতের সবজির বড় পাইকারি বাজার বগুড়ার মহাস্থান হাটে গত সোমবার কৃষকেরা প্রতি কেজি ফুলকপি ৮ টাকা দরে বিক্রি করেন। কেজিতে সাধারণত দুটি ছোট আকারের ফুলকপি হয়। ঢাকার কারওয়ান বাজারে এই ফুলকপি প্রতিটি ১৫-২৫ টাকায় খুচরা বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া সোমবার বগুড়ায় যে বাঁধাকপির দর ১০ টাকা, কারওয়ান বাজারে মানভেদে তা ২০-৩০ টাকায় বিক্রি করেছেন খুচরা বিক্রেতারা। একইভাবে প্রতি কেজি ১৫ টাকার বরবটি ৫০-৬০ টাকা, ১৭-১৮ টাকার বেগুন ৪০ টাকা, ১০ টাকার পেঁপে ২০ টাকায়, ৫ টাকার মুলা ১৫-২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

আরেক বড় পাইকারি বাজার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে নরসিংদীর রায়পুরার জংলি শিবপুরের বাজারেরও একই হাল। এখানে গত রোববার প্রতি কেজি বরবটি ২৫-৩০ টাকা, বেগুন ৩৫-৪০ টাকা, গোল বেগুন ৩০ টাকা, জলপাই ১৫-১৭ টাকা, শিম ৫০ টাকা ও ধনেপাতা ৩৫-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন কৃষকেরা। এর প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে নরসিংদীর বটতলা বাজারে সেই দিনই প্রতি কেজি বরবটি ৬০ টাকায়, বেগুন ৮০, গোল বেগুন ৬০, জলপাই ৩০, শিম ৬০ এবং ধনেপাতা ১০০ টাকায় বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, কৃষকেরা স্থানীয় আড়তদার বা দালালদের কাছে সবজি বিক্রি করেন। তাঁরাই ঢাকার আড়তদারদের সরবরাহ করেন। ফলে পরিবহন খরচসহ প্রতি কেজিতে ৭-১০ টাকা বাড়তি খরচ হয়। ঢাকার আড়তদারদের কাছ থেকে আবার ফড়িয়ারা সবজি কিনে নেন। তাঁরাই পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। চার থেকে পাঁচ হাত ঘুরে খুচরা বাজারে যাওয়ার কারণেই সবজির দাম বেড়ে যায়।

জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের আড়তদার মোহাম্মদ হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন জেলা থেকে সবজি ঢাকায় আনতে ট্রাক ভাড়া, দালাল ও আড়তের কমিশন এবং পণ্য ওঠানো-নামানোতে প্রায় প্রতি কেজিতে ১০ টাকা খরচ আছে। তারপর ফড়িয়া ও খুচরা ব্যবসায়ীর হাত ঘুরে মানুষের কাছে পৌঁছতে দাম বেড়ে যায়।

জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, শীতের সবজি পচনশীল পণ্য হওয়ায় বেশ কয়েকবার হাত ঘুরে ভোক্তার কাছে পৌঁছায়। সে জন্যই দাম বাড়ে, কৃষক তাঁর পণ্যের ন্যায্য দাম পান না এবং ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এসব বন্ধ করতে হলে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সবজি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষকদের নিয়ে সমবায় সমিতি গঠন করা দরকার। যাতে কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার কাছে সরাসরি বিক্রি করতে পারেন। একই সঙ্গে কৃষকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যয় কমানোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। সব ক্ষেত্রেই সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মাঠেই ঠকছেন সবজিচাষিরা

গত সোমবার সকাল ৯টা। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার তালুকপুর মাঠ। খেত থেকে আট মণ মুলা তুলে পানিতে পরিষ্কার করছেন তরুণ কৃষক শাহিন মিয়া। দুজন ব্যাপারী এসেছেন খেত থেকে মুলা কিনতে। শাহিন প্রতি মণ মুলার দাম চাইলেন ৩০০ টাকা। দর-কষাকষির পর ২০০ টাকা মণ (প্রতি কেজি ৫) দরে বিক্রি করে দেন শাহীন।

জানতে চাইলে শাহীন মিয়া বলেন, চার বিঘা জমিতে মুলা চাষ করেছেন। বিঘাপ্রতি খরচ প্রায় ১৬ হাজার টাকা। ফলনও ভালো। তবে দাম কম। এক দিন আগে মহাস্থান হাটে ৭ মণ মুলা বিক্রির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। সারা দিন অপেক্ষার পর প্রতি মণ ২৬০ টাকা মণ দরে বিক্রি করে বাড়ি ফিরেছেন। তিনি বলেন, ‘হাটে সবজির আমদানি বেড়ে যাওয়ায় মুলার দামে ধস নেমেছে। অবস্থা এতই খারাপ যে উৎপাদন খরচ উঠছে না।’

তালুকপুর মাঠ থেকে বগুড়ার মহাস্থান হাটের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। সেই হাটের খুচরা বিক্রেতারা প্রতি কেজি মুলা ১২ টাকায় বিক্রি করছেন।

শিবগঞ্জের ভাগকোলা গ্রামের তরুণ কৃষক সজীব মিয়া সোমবার সকালে ভ্যানে ভরে ফুলকপি নিয়ে মহাস্থান হাটে রওনা দিয়েছিলেন। পথের মাঝেই একজন ব্যাপারী সজীব মিয়ার প্রতি মণ ফুলকপি ৩২০ টাকা মণ (প্রতি কেজি ৮) দরে কিনে নেন। সেদিনই দুপুর ১২টায় হাটে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ফুলকপি ২৪ টাকায় কিনছিলেন তেলিহারা গ্রামের স্কুল শিক্ষিকা নাজমা আকতার। নাজমা বললেন, মহাস্থান হাটের এক প্রান্তে কৃষক সস্তায় সবজি বিক্রি করেন, অথচ হাটের অপর প্রান্তে ওই সবজি খুচরা কিনতে তিন থেকে চার গুণ বেশি দাম গুনতে হয়।

মহাস্থান হাটজুড়ে এখন শীতকালীন সবজির ব্যাপক আমদানি। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সবজি কেনাবেচা হচ্ছে। হাটে বাঁধাকপির বিশাল স্তূপ নিয়ে বসে ছিলেন রায়মাঝিড়া গ্রামের মোকসেদ আলী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এক থেকে দেড় কেজি ওজনের বাঁধাকপি ১০-১২টা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও ছিল ৩০-৩৫ টাকা।

কয়েকজন কৃষক অভিযোগ করে বলেন, ব্যবসায়ী ও আড়তদারেরা সিন্ডিকেট করে সবজির বেশি সরবরাহের সুযোগ নিচ্ছেন। তাঁরা ইচ্ছেমতো দামে সবজি কিনছেন। শহরের পাইকারি মোকামে বেশি দামে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের মুনাফা লুটছেন। কিন্তু কৃষকেরা কম দামে সবজি বেচে লোকসান গুনছেন।

এ বিষয়ে মহাস্থান হাট কাঁচা ও পাকা মাল আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমদানির সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ফড়িয়া কম দামে সবজি কেনেন, এটা সত্যি। তবে আড়তদারেরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন না। তাঁরা কেবল কমিশন নেন।

এদিকে যশোর সদর উপজেলার বারীনগর বাজারে সবজি নিয়ে আসা কৃষক সদর উপজেলার মানিকদিহি গ্রামের সঞ্জয় নন্দী বলেন, ‘২৮ টাকা কেজি দরে ৫ মণ শিম বিক্রি করলাম। গত বছর এ সময়ে ১৫ টাকা কেজি দরে পাইকারি শিম বিক্রি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘খুচরা বাজারে শিম কেজি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইকারিতে কেজি ৪০ টাকা হলেও মোটামুটি লাভ হতো।’

টমেটো চাষের জন্য রাজশাহীর গোদাগাড়ী বিখ্যাত। ইতিমধ্যে নতুন টমেটো উঠতে শুরু করেছে। গোদাগাড়ী থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে রাজশাহী শহরে আসতেই খুচরা বাজারে টমেটোর দাম দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। তবে পাইকারি বাজারে দামের তারতম্য খুব একটা হচ্ছে না।

গত রোববার গোদাগাড়ীর মহিশালবাড়ী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কাঁচা টমেটো তুলে মাঠে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকানোর জন্য ওই টমেটোতে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। লাল রং হলেই টমেটো প্যাকেটজাত করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। কৃষকের কাছ থেকে প্রতি মণ কাঁচা টমেটো ১,৪০০ থেকে ১,৫০০ দরে কেনা হয়। পরে প্রক্রিয়াজাত করে মণপ্রতি ২০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা।

গোদাগাড়ী আচুয়াভিটা গ্রামের ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার বলেন, ভারত থেকে আমদানি করা টমেটোর কারণে তাঁদের টমেটো ভালো বাজার পাচ্ছে না। সরকারের উচিত নভেম্বরের শুরু থেকে ভারতীয় টমেটো আমদানি না করা। না হলে টমেটোচাষিরা কখনোই ভালো দাম পাবেন না।

জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, শীতের সবজি পচনশীল পণ্য হওয়ায় বেশ কয়েকবার হাত ঘুরে ভোক্তার কাছে পৌঁছায়। সে জন্যই দাম বাড়ে, কৃষক তাঁর পণ্যের ন্যায্য দাম পান না এবং ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এসব বন্ধ করতে হলে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সবজি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষকদের নিয়ে সমবায় সমিতি গঠন করা দরকার। যাতে কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার কাছে সরাসরি বিক্রি করতে পারেন। একই সঙ্গে কৃষকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যয় কমানোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। সব ক্ষেত্রেই সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রাজশাহীর আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, বগুড়ার আনোয়ার পারভেজ, যশোরের মনিরুল ইসলাম ও নরসিংদীর প্রণব কুমার দেবনাথ]