ফারমার্স ব্যাংক বাঁচাতে বিশেষ কর্মসূচি

বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংকে জমা রাখা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। ব্যাংকটির শাখাগুলোতে টাকা তুলতে প্রতিদিন ভিড় করছেন গ্রাহকেরা, আর তাঁদের হতাশ করছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। অনেককে পে-অর্ডার দিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে, তবে ব্যাংকের হিসাবে টাকা না থাকায় তাও প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। চলতি সপ্তাহের তিন দিন ব্যাংকটির মতিঝিল, গুলশান, ধানমন্ডি শাখায় সরেজমিন পরিদর্শনে এমন চিত্র দেখা গেছে।

এদিকে টাকা ফেরত পেতে অনেক গ্রাহক বাংলাদেশ ব্যাংকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। তাতেও মিলছে না টাকা। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকটির আমানতকারীদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন ব্যাংকটির জন্য বিশেষ কর্মসূচি বা স্কিমের পরিকল্পনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রেখে গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করতেই মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এ কর্মসূচি নেওয়া হলে ধাপে ধাপে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারবে ব্যাংকটি। এ জন্য পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।

এর আগে ২০০৮ সালে বেসরকারি খাতের ওরিয়েন্টাল ব্যাংক পুনর্গঠন স্কিম গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির মালিকানারও হাতবদল ঘটে। ওরিয়েন্টাল ব্যাংকটি এখন আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক নামে টিকে আছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ কর্মসূচি, মালিকানা বদলের পরও এখনো ব্যাংকটির সব গ্রাহক তাঁদের টাকা ফেরত পাননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিশেষ কর্মসূচির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তাতে ব্যাংকটি থেকে টাকা ফেরত পেতে ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে গ্রাহকদের।

এদিকে নানা অনিয়মের কারণে নগদ অর্থসংকটে পড়া ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান, মতিঝিল ও গাজীপুরের মাওনা শাখার ব্যবস্থাপককে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরই মধ্যে ব্যর্থতার দায়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। চেয়ারম্যানের পদত্যাগের পর ফারমার্সের গুলশান, মতিঝিল, মাওনা শাখাসহ আরও বেশ কয়েকটি শাখায় বিশেষ পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে ব্যাংকটির আরও বড় ধরনের কিছু অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

যোগাযোগ করা হলে ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকের আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি হয়ে গেছে। এ কারণে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না। গত দুই মাসে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার আমানত তুলে নিয়েছেন গ্রাহকেরা। আমরা চেষ্টা করছি ঋণ আদায় করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার। এ ছাড়া বন্ডের অনুমোদন মিলেছে। একটি কোম্পানিকে বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের শেয়ার ছেড়ে মূলধন বাড়ানোরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’

ব্যাংক সূত্র জানায়, মূলধন সংকট কাটাতে ৫০০ কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার অনুমতি পায় ফারমার্স ব্যাংক। এ জন্য ১০ শতাংশ সুদ অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বন্ডটির নাম দেওয়া হয়েছে দি ফারমার্স ব্যাংক প্রসপারেটি বন্ড-২০১৭। বন্ডটির বিপণনের দায়িত্ব পেয়েছে রেইস পোর্টফোলিও অ্যান্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্ট।

এমডিকে অপসারণ

এদিকে ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করার দায়ে ফারমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীমকে অপসারণ করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে। ২৮ ডিসেম্বর এমডি হিসেবে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। অপসারণের পাশাপাশি এ কে এম শামীমকে আগামী তিন বছর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকা অবস্থায় অপসারিত এমডি ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমডিকে অপসারণের চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং তাঁরা সেটি গ্রহণ করেছেন। এর ফলে তিনি আর এমডি পদে বহাল নেই।’

গত ২৬ নভেম্বর এ কে এম শামীমকে অপসারণে নোটিশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়; প্রথমত, ব্যাংকে তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে এমডি ব্যর্থ হয়েছেন। এ কারণে ব্যাংকটি নগদ জমা বা সিআরআরের এবং সংবিধিবদ্ধ জমা বা এসএলআরের অর্থ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা না মেনে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করেছে। নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত শুনানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। এ কমিটিই ১৩ ডিসেম্বর তাঁর শুনানি করে। এরপরই তাঁকে অপসারণ করা হয়।

রাজনৈতিক বিবেচনায় বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে অনুমোদন পাওয়া নতুন ৯ ব্যাংকের একটি ফারমার্স ব্যাংক। অনুমোদন পাওয়ার আগেই সাইনবোর্ড লাগিয়ে দপ্তর খুলে নিয়োগ দেওয়া শুরু করেছিল ব্যাংকটি। ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরুর পর বছর না ঘুরতেই ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে নতুন এই ব্যাংক, যার ভুক্তভোগী এখন সাধারণ আমানতকারীরা।