মাছ চাষ বাড়িয়েছে ধানের ফলনও

বরিশালের উজিরপুর উপজেলার হারতা ইউনিয়নের বাকি দশটি গ্রামের মতো জামবাড়িও বছরের ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে। বিস্তীর্ণ জলাভূমির মধ্যে দ্বীপের মতো জেগে থাকে শুধু বাড়িঘর। পাঁচ-সাত বছর আগেও এই নিচু জমিতে বছরে শুধু একটি ফসল হতো, সেটি বোরো মৌসুমের ধান। আর কিছু রবিশস্য। আশ্বিন-কার্তিক মাস এলেই ঘরে ঘরে অভাব তৈরি হতো। শাপলা-শালুক খেয়ে দিন কাটাত দরিদ্র মানুষ। 

এখন দিন বদলে গেছে। সুদিন এনেছে মাছচাষ। গ্রামের পর গ্রামজুড়ে নিচু জমিতে গড়ে উঠেছে মাছের ঘের। বর্ষায় সেই ঘেরে মাছ বড় হয়। নভেম্বর-ডিসেম্বরে সেই মাছ ধরা হয়। শীতে হয় ধানের আবাদ। বড় বড় ঘেরে মাছ দ্রুত বড় হয়। ধানের ফলন হয় অন্য জমির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। মাছ ও ধান ওই এলাকাকে এখন সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত করেছে। অজপাড়াগাঁয়ের মানুষ পেয়েছে সুদিনের স্বাদ।
হারতা ইউনিয়নটি বরিশাল শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পশ্চিম পাশে উপজেলা সদর পার হয়ে ঘণ্টাখানেক মোটরসাইকেল চালিয়ে বেলা ১১টার দিকে আমরা পৌঁছালাম জামবাড়ি গ্রামে। তখন সেখানকার সবচেয়ে বড় মাছের ঘেরটিতে মাছ ধরছিলেন জেলেরা। ঘেরটির আকার ২৭৫ একর, যা বড় আকৃতির প্রায় ১৫টি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সমান। জমির মালিক স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরা সবাই মিলে জামবাড়ি আদর্শ মৎস্য খামার নামের একটি সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করে ঘেরে মাছ চাষ করেন।
সমিতির কোষাধ্যক্ষ অমলকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, গত বছর তাঁদের ঘেরে ৬৮ লাখ টাকার মাছ উৎপাদিত হয়। প্রতি ১ হাজার টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে শেয়ারধারীরা ছয় মাসে মুনাফা হিসেবে পান ৪৮০ টাকা। এতে শতকরা হিসাবে মুনাফার হার দাঁড়ায় ৯৬ শতাংশ। শীতকালে শুকিয়ে যাওয়ার পর জমির মালিকেরা ধান আবাদ করেন। সেখানে সমিতির ভূমিকা থাকে না।
জামবাড়ি গ্রামের এই ঘেরটি প্রতিষ্ঠিত হয় সাত বছর আগে। এটির সফলতা দেখে ওই এলাকায় আরও অনেকে ঘের করেছেন। মাছ চাষের ফলে এক ফসলি জমি দুই ফসলিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এ ছাড়া শীতে জমি শুকানোর পর তা আগাছায় পরিপূর্ণ থাকত। ধান আবাদের জন্য পরিষ্কার করতে বিঘাপ্রতি চার-পাঁচ হাজার টাকা খরচ হতো। মাছ চাষের ফলে তা লাগছে না। যাঁদের জমি নেই, কিন্তু ঘেরের পাশে বাড়ি, তাঁরাও চার হাজার টাকা করে বিনিয়োগ করে সমিতির সদস্য হতে পারেন। মাছ বিক্রির মুনাফা তাঁরাও পান।
অমলকৃষ্ণ বিশ্বাস, প্রফুল্ল মল্লিক, অমূল্য রঞ্জন রায়সহ স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার সময়ই জেলেরা জাল গুটিয়ে আনলেন। শুরু হলো মাছেদের লাফালাফি। জালের মধ্যে রুই, কাতলা, গ্রাসকার্প, মিরর কার্প, বিগ হেড, সিলভার কার্প ইত্যাদি কার্পজাতীয় মাছ দেখা গেল। আরও উঠল চিতল, কয়েকটি শোল ও কিছু খলশে মাছ। এসব মাছ মণপ্রতি গড়ে চার হাজার টাকায় বিক্রি হয়।
অমলকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, তাঁরা মূলত একটু বড় আকারের মাছ পোনা হিসেবে ছাড়েন। ছয় মাসে কিছু কিছু মাছ আড়াই থেকে তিন কেজি পর্যন্ত ওজন হয়। এ বছর ঘেরে মাছ ছাড়া, খাবার দেওয়া এবং পরিচর্যার পেছনে ৩৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। মাছের উৎপাদন গত বছরকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সাধারণভাবে ঘের বলতে যা বোঝায় জামবাড়ির ঘেরগুলো সে রকম নয়। এগুলো মূলত নিচু কৃষিজমি। সেখানে মাছ চাষের জন্য মাটি খনন করতে হয়নি। ঘেরের পাড় হিসেবে কাজ করছে গ্রামীণ সড়ক। নিচু জমির কারণে উজিরপুরের পশ্চিমাংশের হারতা, সাতলা ও জল্লা ইউনিয়নের গ্রামগুলো পুবের মানুষের কাছে বিলাঞ্চল নামে পরিচিত। বছর দশেক আগেও ওই সব গ্রামে যাওয়ার ক্ষেত্রে নৌকাই ছিল একমাত্র বাহন। এখন পাকা সড়ক হয়েছে।
উজিরপুরের উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, নিচু জমি থেকে বর্ষায় চাষিরা কিছুই পেতেন না। এখন তাঁরা লাভজনকভাবে মাছ চাষ করছেন। মাছের খামারে ব্যবহার করা ভুসি, খাবার ও সারের কারণে জমি উর্বর হয়। এতে খুব কম খরচে বিপুল পরিমাণে ধান হয়। তিনি জানান, উজিরপুর উপজেলায় এখন সাত হাজার টনের মতো মাছ উৎপাদিত হয়, যার বেশির ভাগ হয় হারতা, সাতলা ও জল্লা ইউনিয়নে।
বাংলাদেশে চাষের মাধ্যমে বছরে ২১ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়। হারতার চাষিদের মতো লাখ লাখ চাষিই বাংলাদেশকে বিশ্বে মাছ উৎপাদনে পঞ্চম করেছে। মাছের অর্থনীতি হারতা, জল্লা ও সাতলা ইউনিয়নে নানা পরিবর্তন এনেছে। ওই অঞ্চলে দুটি বড় মাছের পাইকারি বাজার তৈরি হয়েছে। মাছ বিক্রি বাবদ কোটি কোটি টাকা প্রতিবছর গ্রামের মানুষের হাতে যাচ্ছে। সেই টাকায় উজিরপুরের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের আমানত বাড়ছে। পণ্যের ভোগ, শিক্ষা, চিকিৎসায় অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। নতুন নতুন দোকান খুলছে। মাছ চাষ, ধরা ও পরিবহনকে কেন্দ্র করে নানা পেশায় তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থান।
মাছ ধরে জেলেরা মাছের মোট দামের ৮ শতাংশ পান। পরিবহনশ্রমিকেরা ভাড়া পান, আড়তদারেরা কমিশন পান, ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জায়গায় সেই মাছ বিক্রি করে মুনাফা করেন। তাঁদেরই একজন প্রফুল্ল মল্লিক বছরে ছয় মাস মাছের ঘেরে পরিচর্যার কাজ করেন। মাসে তাঁর বেতন নয় হাজার টাকা। তিনি বলেন, মাছ আর ইরি ধান এলাকার মানুষের ভাগ্য ফিরিয়েছে। আগে এক বেলা, আধা বেলা খেয়ে থাকতে হতো। এখন আর ভাতের কষ্টে কেউ নেই।
হারতা বাজারে তিন বছর আগে কৃষি ব্যাংক শাখা খুলেছে। গত কয়েক বছরে সেখানে টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটরের মতো ইলেকট্রনিকস পণ্যসামগ্রীর দোকান হয়েছে। এমনকি দেশের একটি নামী ব্র্যান্ড সেখানে আসবাবপত্রের পরিবেশক নিয়োগ করেছে। আসবাবপত্রের ব্র্যান্ডটির পরিবেশক রানা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ব্র্যান্ডের আসবাবপত্র সেখানে মোটামুটি ভালো চলছে। জানতে চাইলাম, নামী ব্র্যান্ডের দামি আসবাব কেনার অর্থ আসে কোথা থেকে? উত্তরে তিনি বললেন, আয়ের দুটি বড় উৎস মাছ ও ধান।
এলাকার অনেক কৃষক কার্পজাতীয় মাছের পাশাপাশি অন্যান্য মাছও চাষ করেন। কেউ চাষ করেন কই, কেউ শিং, কেউ আবার গলদা চিংড়ি। চিংড়িচাষিদের একজন নিরঞ্জন বিশ্বাসের বাড়িতে গেলাম বেলা দুইটা নাগাদ।
নিরঞ্জন বিশ্বাস গত বছর ২৪০ শতাংশ জমিতে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে চিংড়ি চাষ করে তা আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করেন। আর ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে ধান আবাদ করে তা বিক্রি করেন ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। এর পাশাপাশি তিনি ঘেরের পাশে সবজি চাষ করেন। সবজি বিক্রির টাকায় তাঁর একজন শ্রমিকের পুরো বছরের বেতন হয়ে যায়। ঘরে খাওয়ার জন্য রাখা ৩০ মণ ধান ও কার্পজাতীয় মাছ হিসেবে বাইরে রেখেছেন তিনি। ওই চাষি আরও বলেন, মাছ চাষ করলে ধানে তেমন খরচ হয় না। আবার ঘেরের পাড়ে সবজিও হয় ভালো।
উজিরপুরের এসব মাছের ঘেরের সমস্যা একটাই। দুই মাস একসঙ্গে যখন সব ঘেরে মাছ ধরা হয়, তখন বাজারে দাম কমে যায়। একবার মাছ ধরে বাজারে নিলে তা আর ফেরত আনা যায় না। তাই কম দামে বিক্রিতে বাধ্য হন চাষিরা। মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, হারতায় একটি হিমাগার হলে সমস্যা আংশিক হলেও কাটানো যেত।