দাম নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ প্রয়োজন

‘ভাই, পেঁয়াজ কত?’ 

‘নতুন পেঁয়াজ ৯০।’
‘এখনো ৯০, এ বছর আর কমলই না দাম!’

হতাশা দেখা গেল ক্রেতার চেহারায়। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পেঁয়াজের বাজারে গতকাল বছরের শেষ দিন ক্রেতা-বিক্রেতার এ কথোপকথন কানে এল।

রাহাত আলী নামের ওই ক্রেতার বললেন, ‘নাজিরশাইল চাল কিনলাম ৭০ টাকা কেজি দরে। পেঁয়াজ এখনো ৯০। ভাত আর পেঁয়াজ খাওয়া ছেড়ে দেওয়া গেলেই মনে হয় বাঁচতাম। সাতজনের সংসার। এই বাজারে চলে না। বছর শেষ হতে চলল, কিন্তু চাল, পেঁয়াজের দাম কমে না।’

শেষ হয়েছে আরেকটি বছর। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে উন্নতির ধারা বজায় ছিল বিদায়ী বছরটিতে। এই সাফল্য পুরোটা উপভোগ সম্ভব হয়নি লাগামহীন চালের বাজারের কারণে। পণ্যবাজারে শুধু চাল নয়, সবজি, মাছ, মাংস, পেঁয়াজ ও মসলার দামও বছরজুড়ে দফায় দফায় বেড়েছে। নতুন বছরে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে তাই শুরু থেকেই পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, বিদায়ী বছরে আগাম বন্যার কারণে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল। এই আগাম বন্যা কিন্তু প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল। হাওর অঞ্চলে যদি শক্ত ও দৃঢ় বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হতো, তাহলে এই বন্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। সমস্যা মোকাবিলায় আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে হাওর অঞ্চলে বাঁধ ঠিক করা জরুরি। না হলে আবারও বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া বোরোর মৌসুম শুরু হবে। এই মৌসুমে কৃষক যেন প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ও সার পান, তা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে হবে। ভালো ফসল হলে দাম কমে আসবে।

বিদায়ী বছরে বাজার পর্যবেক্ষণে চরম অব্যবস্থাপনা ছিল বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘মনিটরিং হয়নি। সরকারকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। বাজারব্যবস্থায় জবাবদিহি করতে হবে। শুধু দেশীয়ভাবে কেনাকাটা নয়, আমদানির ক্ষেত্রেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া আমাদের মজুত সব সময় ১৫ লাখ টনে রাখতে হবে।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও মনে করেন, সরকারের বাজার মনিটরিংয়ের বিষয়টি এ বছর আগের মতো হয়নি। সরকারের এ ক্ষেত্রে ভূমিকাটা কম ছিল। তিনি বলেন, চাল ও পেঁয়াজের দাম বিদায়ী বছরে বাড়ার অন্যতম কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যার কারণে প্রথমে বোরো ধান, পরে আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর পেঁয়াজের বাজারও দুর্যোগে পড়ে। তবে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আমদানির একটা বিষয় ছিল। কিন্তু এবার ভারতেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পেঁয়াজের দাম বেশি ছিল।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নিত্যপণ্যের বাজারে এবার মূল্য স্থিতিশীল রাখতে বড় দুর্বলতা ছিল কতিপয় বড় ব্যবসায়িক গ্রুপের বাজারে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার মতো জোগান কাঠামো তৈরি হয়েছে। তারা তাদের প্রভাব বাজারে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছে। সরবরাহজনিত কৃত্রিম একটি ঘাটতি তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে সমস্যা যা হয়েছে, বাজারে মনিটরিং আগের মতো নেই। নতুন বছরে সরকারকে দেখতে হবে, বড় গ্রুপগুলো বাজারে প্রতিযোগিতামূলক সরবরাহ করছে কি না। আইনের আওতায় এতে সরকারকে মনিটরিং করতে হবে। বেসরকারি খাতের রোল কতটা প্রতিযোগিতামূলক হচ্ছে, তা সরকারের দেখার একটা রোল আছে।

বছরের শুরুতে চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ৪০ টাকা, মে মাসে তা ৫০ টাকায় উঠল। সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে নভেম্বরে তা কমে ৪২ টাকায় নেমে এসেছিল। কিন্তু ডিসেম্বরে আবার দাম বেড়েছে চালের। এপ্রিলে হাওরে বন্যায় ফসলের ক্ষতির পর থেকে বাড়তে শুরু করে চালের দাম। সে সময় সরকারের গুদামগুলোয় চালের মজুত দুই লাখ টনেরও নিচে নেমে আসে। সে সুযোগে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়ে দেন। মে মাসে ছয় বছর পর অবশেষে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রাথমিকভাবে এক লাখ টন চাল আমদানির পরিকল্পনা নেয় তারা। এরপর সারা দেশে বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলে আরেক দফা বাড়ে চালের দাম। দুই দফায় শুল্ক কমিয়েও চালের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে পারেনি সরকার।

পেঁয়াজের ক্ষেত্রে বছরের প্রথম ছয় মাস ভালো কাটলেও জুনে লাগাম ছুটে দামের। জুলাইয়ে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়ে বিক্রি শুরু হয় ৫০ টাকায়। এরপর আমদানি বাড়লে কমলেও অক্টোবরে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারত কয়েক দফা এলসি মূল্য বাড়ালে প্রথমবারের মতো ১০০ টাকা কেজি হয়ে পেঁয়াজের। ডিসেম্বরে ১২০ টাকায় ওঠে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম। বলা হচ্ছিল, বাজারে নতুন পেঁয়াজ উঠলে কমে আসবে দাম। তবে নতুন পেঁয়াজ উঠলেও দাম সেই বছর শেষেই ১০০-এর ঘরেই থাকল।

টিসিবির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বাজারে কেজিপ্রতি দেশি নতুন পেঁয়াজ ৮০ থেকে ১০০ টাকা ও আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭৫ টাকায়। ঠিক এক বছর আগের চেয়ে যা ১৬১ ও ২০০ শতাংশ বেশি। চালের খুচরা বাজারের তথ্য অনুযায়ী কেজিপ্রতি মোটা চালের দাম এখন ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা। মাঝারি মানের চাল ৪৮ থেকে ৫৬ টাকা। আর ভালো মানের চালের দাম গিয়ে ৫৮ থেকে ৬৮ টাকায়। এর মধ্যে কেজিপ্রতি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় টাকায়। মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৮ টাকায়।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। বিদায়ী বছরের শেষ দিকে এসে তা বেড়ে ৬ শতাংশ অতিক্রম করেছে। অক্টোবরে মাসওয়ারি ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি হয় ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। আর ১২ মাসের গড় হিসাবে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। মূলত খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

তবে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য চলতি অর্থবছরে অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি যেসব পণ্যের দামের ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় হয়, তাতে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সম্ভাবনা নেই। এমনিতেই ভোটের বছর। একটু ঊর্ধ্বমুখী থাকে বাজার। বিদায়ী বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে চাল আমদানির ক্ষেত্রে সরকারের মুনশিয়ানা ভাবটা কমাতে হবে। এখন থেকে নতুন বছরের মজুত দেখে আমদানির পরিকল্পনা নিতে হবে। আমদানির বিষয়টি এখন থেকেই বিবেচনায় নিতে হবে এবং খোলা বাজারে চাল ও নিত্যপণ্য বিক্রির বিস্তার বাড়াতে হবে। সারা দেশে এই কার্যক্রম পালনে টিসিবিকে বড় ভূমিকা নিতে হবে।’

বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে আরও সদয় হবে হবে—এমন মন্তব্য করে নাজনীন আহমেদ বলেন, দয়া করে খাদ্য মন্ত্রণালয় মানুষের প্রতি একটু সদয় হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় একটি সংবেদনশীল মন্ত্রণালয়। তাদের সামান্য ভুল মানুষের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনে। এ জন্য তাদের সদয় হতে হবে।