এলপি গ্যাসের 'হাব' মোংলা

মোংলা বন্দরকে কেন্দ্র করে এলপি গ্যাসের বেশ কয়েকটি টার্মিনাল গড়ে উঠেছে। তারই একটি নাভানা এলপিজি। সম্প্রতি উৎপাদন শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি l ছবি: প্রথম আলো
মোংলা বন্দরকে কেন্দ্র করে এলপি গ্যাসের বেশ কয়েকটি টার্মিনাল গড়ে উঠেছে। তারই একটি নাভানা এলপিজি। সম্প্রতি উৎপাদন শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি l ছবি: প্রথম আলো

ফুরিয়ে আসছে প্রাকৃতিক গ্যাস। তীব্র হচ্ছে গ্যাসের সংকট। দীর্ঘদিন ধরে গৃহস্থালিতে নতুন গ্যাসের সংযোগ দেওয়া বন্ধ রেখেছে সরকার। শিল্পকারখানায় গ্যাসের চাহিদা মেটাতে আসছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। অন্যদিকে বাসাবাড়িতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ব্যবহার।

চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এলপি গ্যাসের আমদানিতে যুক্ত হয়েছে প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠান। এলপি গ্যাসের সিংহভাগই বাগেরহাটের মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি হচ্ছে। বন্দরের নিজস্ব জায়গা ইজারা নিয়ে ও বাইরের জায়গা কিনে গড়ে উঠেছে বসুন্ধরা, যমুনা, নাভানা, ওরিয়ন, ওমেরা, সেনা কল্যাণ ও লাফস গ্যাসের বিশাল কারখানা বা টার্মিনাল। প্রতিষ্ঠানগুলো পশুর নদে ল্যান্ডিং স্টেশন করে এলপি গ্যাস বোঝাই জাহাজ নোঙর করার ব্যবস্থা করেছে। জাহাজ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে টার্মিনালের ট্যাংকে জমা হচ্ছে এলপি গ্যাস। তারপর তা সিলিন্ডার ভর্তি হয়ে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। শিগগিরই উৎপাদনে আসছে পেট্রোম্যাক্স, ডেলটা ও মীর এলপিজি। মোংলার বাইরে চট্টগ্রামে টোটাল গ্যাস, বিএমসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের এলপি গ্যাসের টার্মিনাল আছে।

এ খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বসুন্ধরা, ওমেরা, যমুনা, লাফস গ্যাসসহ প্রায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে মাসে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার ৫০ হাজার মেট্রিক টন এলপি গ্যাস বাজারজাত করছে। এর মধ্যে ৮১ শতাংশ বাসাবাড়ি, ছোট মাঝারি শিল্পে ১৪ শতাংশ, বড় শিল্পে ১ শতাংশ, পরিবহনে ১ শতাংশ ও অন্যান্য খাতে ৩ শতাংশ এলপি গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। এলাকাভেদে ১২ কেজির এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার ১০০০-১১০০ টাকা ও ৪৫ কেজির সিলিন্ডার ৩২০০-৩৬০০ টাকায় কিনতে হয় ক্রেতাদের।

মোংলা বন্দরের কর্মকর্তারা জানালেন, এলপি গ্যাসের টার্মিনালের কারণে বন্দর ব্যবহার বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোংলা বন্দর দিয়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন এলপি গ্যাস আমদানি হয়েছে। তার আগের অর্থবছরে ১ লাখ ৬৪ হাজার মেট্রিক টন আমদানি হয়েছিল। অবশ্য ২০০৪-০৫ অর্থবছরেও এলপি গ্যাস আমদানির পরিমাণ ছিল মাত্র ২৬ হাজার মেট্রিক টন। বন্দরের ২০টি প্লট শিল্প স্থাপনের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর এ কে এম ফারুক হাসান গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে একসময় বন্দরের কার্যক্রম গতি হারিয়েছিল। তখন বসুন্ধরা, সেনা কল্যাণ সংস্থাসহ বড় শিল্প গ্রুপকে বন্দরের শিল্প এলাকায় প্লট বরাদ্দ দেয় কর্তৃপক্ষ। সেই ধারাবাহিকতায় মোংলায় সিমেন্ট, এলপিজি প্ল্যান্ট, তেল পরিশোধন কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তবে নতুন করে আমরা প্লট বরাদ্দ দিচ্ছি না।’

৯ জানুয়ারি মোংলায় গিয়ে দেখা যায়, মোংলা-খুলনা মহাসড়কের দ্বিগরাজ বাসস্ট্যান্ড পার হলেই সড়কের দুপাশে একের পর এক এলপি গ্যাসের কারখানা। পাশাপাশি সিমেন্ট, তেল পরিশোধনসহ অন্যান্য কিছু কারখানাও আছে। পেট্রোম্যাক্সের এলপি গ্যাসের কারখানার নির্মাণকাজ চলছে। গ্যাস সংরক্ষণের জন্য ইতিমধ্যে বসানো হয়েছে তিনটি বিশাল আকৃতির ট্যাংক। জাহাজ থেকে গ্যাস কারখানার ট্যাংকে আনার জন্য ইতিমধ্যে পশুর নদী পর্যন্ত পাইপলাইন বসানো হয়েছে। আগামী মে মাসে উৎপাদনে যেতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। পেট্রোম্যাক্সের উল্টো পাশে নাভানা এলপি গ্যাসের কারখানা উৎপাদন শুরু করেছে।

মোংলা বন্দরের ১০ একর জমি ইজারা নিয়ে কারখানা করেছে ওরিয়ন এলপিজি। তাদের দুটি ট্যাংকে গ্যাস সংরক্ষণ ক্ষমতা ৩ হাজার মেট্রিক টন। ৮ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে দিনে ৫ থেকে ৬ হাজার সিলিন্ডার এলপি গ্যাস বাজারজাত করছে তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা বলেন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে এলপি গ্যাস ও ভারত থেকে সিলিন্ডার আনছে ওরিয়ন।

২০০১ সালে ক্লিন হিট গ্যাস কোম্পানি মোংলায় এলপিজি টার্মিনাল করে। ২০১৫ সালে সেটি শ্রীলঙ্কার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান লাফস গ্যাসের কাছে যায়। বর্তমানে তাদের টার্মিনালে এলপি গ্যাসের ধারণক্ষমতা ১ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। দিনে ৩০ হাজার সিলিন্ডার বাজারজাত করছে তারা। একই সঙ্গে ঢাকা, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন জেলায় ৯টি অটো গ্যাস স্টেশন আছে। সেখান থেকে অনেক গাড়ি জ্বালানি হিসেবে এলপি গ্যাস নিয়ে থাকে।

লাফস গ্যাসের (বাংলাদেশ) বিপণন বিভাগের উপব্যবস্থাপক তৌসিফ ইসলাম বলেন, বাসাবাড়িতে এলপি গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। অন্যদিকে শিগগিরই পরিবহনে জ্বালানি হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে এলপি গ্যাস। কারণ সিএনজির চেয়ে এলপি গ্যাসে মাইলেস বেশি পাওয়া যায়। তিনি বলেন, প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও বর্তমানে বাজারে একধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এতে করে অনেক প্রতিষ্ঠান সিলিন্ডারের মান বজায় রাখছে না। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

বন্দরের সাড়ে ৫ একর জায়গা ইজারা নিয়ে এলপি গ্যাসের কারখানা করছে ডেলটা এলপিজি। আগামী সেপ্টেম্বরে উৎপাদন শুরুর লক্ষ্য নিয়ে নির্মাণকাজ চলছে কারখানাটির। তাদের কারখানায় মাসে ৪ হাজার মেট্রিক টন এলপি গ্যাস সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এখান থেকে প্রতিদিন ৩ হাজারের বেশি সিলিন্ডার বাজারজাত করবে তারা। একই সঙ্গে দেশের কয়েকটি এলাকায় স্যাটেলাইট স্টেশন করার পরিকল্পনা নিয়েছে ডেলটা। মোংলা থেকে সেই স্টেশনগুলোতে গ্যাস নিয়ে সংরক্ষণ করা হবে। তারপর বোতলজাত (সিলিন্ডার) করে বাজারে ছাড়া হবে।

ডেলটা এলপিজির মহাব্যবস্থাপক এস এম নাছির উদ্দিন আল মামুন বলেন, ‘এলপি গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিনই বাড়ছে। বর্তমানে বাসাবাড়িতে মূল চাহিদা থাকলেও ভবিষ্যতে গাড়ির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হবে এলপিজি। হাজার হাজার এলপিজি বা অটো গ্যাস স্টেশন হবে। সেই স্টেশনেও আমরা বড় ট্যাংকারে করে গ্যাস সরবরাহ করব। ফলে নিকট ভবিষ্যতেই এলপি গ্যাসের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যাবে।’

মোংলায় কারখানা করার বিষয়ে ডেলটা এলপিজির এই মহাব্যবস্থাপক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে ফাঁকা জায়গা নেই। তবে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ তুলনামূলক সস্তায় জমি ইজারা দিয়েছে। পাশেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। এসব চিন্তা করেই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বাজার

মাসে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা

বাজারজাত ৫০ হাজার টন

ব্যবহার

বাসাবাড়িতে      ৮১%

ছোট মাঝারি শিল্পে        ১৪%

বড় শিল্পে        ১%

পরিবহনে         ১%

অন্যান্য   ৩%

দাম

১২ কেজির সিলিন্ডার ১০০০-১১০০ টাকা

৪৫ কেজির সিলিন্ডার ৩২০০-৩৬০০ টাকা