ফোর-জির মান ঠিক থাকবে তো?

  • তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো, বেতার তরঙ্গ, ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের মান ও হ্যান্ডসেট
  • বাংলাদেশ এখনো প্রত্যাশিত অগ্রগতি অর্জন করেনি।

দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ প্রজন্মের (ফোর-জি) টেলিযোগাযোগ সেবা চালু হতে যাচ্ছে। মোবাইল ফোন অপারেটররা বলছে, সেবাটি চালু হলে ইন্টারনেটের গতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বর্তমানে চালু থাকা তৃতীয় প্রজন্মের (থ্রি-জি) সেবার মান নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাযথ অবকাঠামো নিশ্চিত না করে ফোর-জি চালু করা হলে তা থেকে মানসম্মত সেবা পাওয়া যাবে না।
খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ফোর-জি সেবা দেওয়ার জন্য তিনটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে বেতার তরঙ্গ, ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের মান ও হ্যান্ডসেট। তিনটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখনো প্রত্যাশিত অগ্রগতি অর্জন করেনি।
গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের হাতে যে পরিমাণ তরঙ্গ এখন আছে, তা যে যথেষ্ট নয়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পাশাপাশি অপারেটররাও স্বীকার করে। অপারেটরদের তরঙ্গস্বল্পতা দূর করতে গত মঙ্গলবার তরঙ্গ নিলামের আয়োজন করে বিটিআরসি। গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক এ নিলামে অংশ নেয়। বিক্রির জন্য ৪৬ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গ নিলামে তোলা হলেও বিক্রি হয়েছে ১৫ দশমিক ৬ মেগাহার্টজ। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ তরঙ্গ অবিক্রীত থেকে গেছে।
অপারেটররা বলছে, বেশি দামের কারণে ইচ্ছা থাকলেও আরও বেশি তরঙ্গ তারা কিনতে পারেনি। ২০১৩ সালে থ্রি-জি প্রযুক্তি চালুর পর সব অপারেটর মিলে গত চার বছরে এ খাতে ৩২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এর বিপরীতে থ্রি-জি থেকে তারা ফেরত পেয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যে তরঙ্গ কেনা ও প্রযুক্তি নিরপেক্ষতার জন্য সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা চলে গেছে। নেটওয়ার্ক উন্নয়নে আগামী দু-তিন বছরে কমপক্ষে আরও প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে।
সারা দেশে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের দুর্বলতাও নিরবচ্ছিন্ন ফোর-জি সেবার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যান্ডউইটথ সরবরাহের জন্য দুটি সাবমেরিন কেব্‌ল থাকলেও এগুলো থেকে প্রত্যাশিত ব্যান্ডউইটথ পাওয়া যাচ্ছে না ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের দুর্বলতায়। এই অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিতের দায়িত্ব আবার মোবাইল অপারেটরদের হাতে নেই। বিটিআরসিও ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক উন্নয়নে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি বলে খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন। জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের মহাসচিব টি আই এম নুরুল কবীর বলেন, ফোর-জিতে ভালো গতি পেতে হলে ফাইবার অপটিক সরবরাহ ব্যবস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু বেতার তরঙ্গ দিয়ে দ্রুতগতির ফোর-জি সেবা পাওয়া যাবে না।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওপেন সিগন্যালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে ফোর-জি প্রযুক্তির গড় গতি ১৬ দশমিক ৬ এমবিপিএস (মেগাবিটস প্রতি সেকেন্ড)। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ফোর-জির গড় গতি বর্তমানে ৬ দশমিক ১৩ এমবিপিএস। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো দেশে ফোর-জির গতি ৯ থেকে ১৪ এমবিপিএসের মধ্যে।
বাংলাদেশে ফোর-জির গড় গতি ৭ থেকে ১০ এমবিপিএস হতে পারে বলে অপারেটর ও বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে।
টেলিযোগাযোগ-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ গবেষক আবু সাইদ খান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে ফোর-জি ইন্টারনেটের গতি কত হবে, তা নিয়ে সরকার ইতিমধ্যেই মোবাইল ফোন অপারেটরদের কাছে নতি স্বীকার করেছে। মিয়ানমারে যেখানে ফোর-জি গ্রাহকেরা ৫০০ এমবিপিএস (মেগাবিটস প্রতি সেকেন্ড) পর্যন্ত গতি পাচ্ছেন, সেখানে বাংলাদেশে এই গতি ২০ এমবিপিএসও হবে না। নিম্নমানের সেবা প্রদানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও অপারেটরদের মধ্যে অলিখিত সমঝোতা আছে বলে মনে হয়।
মোবাইল অপারেটরদের হিসাবে, বাংলাদেশে এখন ফোর-জি উপযোগী হ্যান্ডসেটের সংখ্যা গড়ে ১০ শতাংশ। হ্যান্ডসেট ব্যবহারকারীদের বেশির ভাগেরই অবস্থান ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে।
সার্বিক বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ফোর-জি চালুর পরে সেবার মান কতটা নিশ্চিত হলো, সেটা কঠোরভাবে দেখা হবে। এ জন্য সেবার মানসংক্রান্ত একটি নীতিমালা সম্প্রতি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এদিকে চার মোবাইল ফোন অপারেটরকে ফোর-জি সেবার লাইসেন্স দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে সরকার, যা তারা ১৯ ফেব্রুয়ারি পাবে। গত মঙ্গলবার ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে এই অনুমোদন এসেছে।