সংকটে অ্যালুমিনিয়াম শিল্প

>

চট্টগ্রাম নগরের মোহাম্মদপুর এলাকায় এক গলিতেই গড়ে উঠেছে শতাধিক অ্যালুমিনিয়াম কারখানা। এ কারণে এ গলি স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে অ্যালুমিনিয়াম গলি হিসেবেও পরিচিত। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে এই গলিতেই যাত্রা শুরু হয়েছিল এ ক্ষুদ্র শিল্পের। মোহাম্মদপুরের এ অ্যালুমিনিয়াম শিল্প এলাকার অতীত, বর্তমান ও সমস্যা নিয়ে আজকের বিশেষ আয়োজন।

শীর্ষ পর্যায়ের অ্যালুমিনিয়াম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান দিল্লি অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় কর্মব্যস্ত শ্রমিকেরা। ছবিটি সম্প্রতি তোলা।  প্রথম আলো
শীর্ষ পর্যায়ের অ্যালুমিনিয়াম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান দিল্লি অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় কর্মব্যস্ত শ্রমিকেরা। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। প্রথম আলো

মির্জাপুল ব্রিজ পেরিয়ে অ্যালুমিনিয়াম গলিতে ঢোকার মুখে কানে বাজল পাতিলের টুংটাং শব্দ। গলিতে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই রাস্তার পাশে দেখা গেল সারি সারি অ্যালুমিনিয়াম তৈজসপত্রের ছোট ছোট কারখানা। অ্যালুমিনিয়ামের গোলাকার পাত ঘূর্ণমান ছাঁচে ফেলে তৈরি করা হচ্ছে হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, কড়াইসহ বহু ধরনের তৈজসপত্র। সদ্য তৈরি করা এসব হাঁড়ি-পাতিল রাখা হয়েছে কারখানার সামনে। কোথাও রাস্তার পাশে।
কারখানাগুলো যেখানে, সেটি মোহাম্মদপুর এলাকা। অ্যালুমিনিয়াম শিল্পের কারণে এই এলাকার পরিচিতি এখন অ্যালুমিনিয়াম গলি নামে। এখান থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই ক্ষুদ্র শিল্পের। যাত্রা শুরুর তিন দশকের মাথায় সারা দেশে অ্যালুমিনিয়াম তৈজসপত্রের বাজারের বড় অংশের জোগান দিত এখানকার কারখানাগুলো। তবে এখন সেই অবস্থা নেই। দিনে দিনে এখানে কমছে কারখানার সংখ্যা। কমছে উৎপাদনও।
যেখান থেকে একসময় এই তৈজসপত্রের বাজার নিয়ন্ত্রণ হতো, সেখানে এখনকার অবস্থা জানতে কথা হয় পুরোনো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে। অ্যালুমিনিয়াম গলির মুখে দোতলায় চট্টগ্রাম অ্যালুমিনিয়াম শিল্প মালিক সমিতির কার্যালয়ে পাওয়া গেল কারখানা ও উৎপাদন-সংক্রান্ত হিসাব। সমিতির নেতারা বলেন, ২০১০ সালে চট্টগ্রামে এই খাতের কারখানার সংখ্যা ছিল ১৪২। তখন দিনে ২০ থেকে ২২ হাজার কেজি তৈজসপত্র উৎপাদন হতো। সাত বছরের ব্যবধানে এখন কারখানা কমে দাঁড়িয়েছে ১২০ টিতে। তৈজসপত্র উৎপাদন হচ্ছে বড়জোর ১৫ থেকে ১৬ হাজার কেজি। এই হিসাবে বছরে ৬০ লাখ কেজি হাঁড়ি-পাতিল, কলসিসহ তৈজসপত্র উৎপাদন হয়। সংখ্যার হিসাবে বছরে ১৮০ কোটি টাকার অন্তত ২ কোটি পিস ছোট-বড় হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, কড়াই, সসপ্যান, বড় ডেকচি উৎপাদন হচ্ছে চট্টগ্রামে।
সমিতির নেতা এবং কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় বছরে ২০০ কোটি টাকার অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র বেচাকেনা হয়, যার ৯০ শতাংশ উৎপাদন হয় চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে। এসব কারখানার ১১০টিই অ্যালুমিনিয়াম গলিতে। এই গলির বাইরে দুটি বড় কারখানা আছে চট্টগ্রামে। এর একটি নাছিরাবাদ শিল্প এলাকায় দিল্লি অ্যালুমিনিয়াম, আরেকটি আতুরার ডিপোতে ভূঁইয়া অ্যালুমিনিয়াম। উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রতিদিন অন্তত ১ হাজার কেজি অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র ঢাকার উৎপাদকেরা সরবরাহ করেন। তবে বড় ডেকচির মতো কিছু মানসম্মত তৈজসপত্র এখনো চট্টগ্রাম থেকে দেশের নানা স্থানে সরবরাহ করা হয়।
চট্টগ্রামে কারখানার সংখ্যা কমে যাওয়ার বড় কারণ হচ্ছে, জমি মালিকেরা শহরের মূল্যবান জায়গায় এই কারখানা রাখতে চান না। বহুতল ভবন নির্মাণের দিকে ঝুঁকছেন জমির মালিকেরা। গত ডিসেম্বরেও অ্যালুমিনিয়াম গলির মুখে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ২০টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজন উদ্যোক্তা নতুন করে জায়গা খুঁজলেও স্বল্প পুঁজির উদ্যোক্তাদের কারখানার বেশির ভাগই আর চালু হচ্ছে না। এমনই একজন রহমান মেটাল ওয়ার্কসের কর্ণধার আবদুর রহমান। গত বুধবার গলির মুখে দাঁড়িয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এই জায়গায় প্রায় ৪২ বছর ধরে ছিলাম। এখন জমির মালিক কারখানার জন্য জমি ভাড়া দিতে চাইছেন না। তাই আমাদেরও কারখানা বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। নতুন করে বিনিয়োগ করে কারখানা চালানো সম্ভব নয়। এখন যন্ত্রপাতি লোহার দরে বিক্রি করতে হবে।’
চট্টগ্রাম অ্যালুমিনিয়াম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মো. হারুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, অ্যালুমিনিয়াম গলিতে যাঁরা কারখানা ভাড়া দিয়েছেন, তাঁরা এখন বহুতল ভবন নির্মাণে ঝুঁকছেন। স্বল্প পুঁজির কারখানার উদ্যোক্তাদের নতুন জায়গায় ভাড়া নিয়ে কারখানা চালানো সম্ভব নয়। শহরের কাছাকাছি কোনো খাসজমি বরাদ্দ দিলে এই শিল্প রক্ষা পাবে।
জমির পাশাপাশি দেশের অন্য এলাকার চেয়ে এক দশক ধরে চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের অ্যালুমিনিয়াম তৈজসপত্র উৎপাদনে বেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে জানালেন কয়েকজন কারখানামালিক। তাঁরা জানান, এই শিল্পের কাঁচামাল ‘অ্যালুমিনিয়াম ইনগট’ চুল্লিতে গলিয়ে পাত তৈরির জন্য দরকার গ্যাস। চট্টগ্রামে গ্যাসের সংকট দীর্ঘদিন ধরে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় অ্যালুমিনিয়াম পাত তৈরিতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। এই খাতে নতুন শ্রমিকও যোগ হচ্ছেন না। আবার পুরোনো শ্রমিকদের মজুরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় এখানে বেশি। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামের কারখানাগুলো প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে।
চট্টগ্রাম অ্যালুমিনিয়াম শিল্প মালিক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. খোরশেদ আলম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় চট্টগ্রামে অ্যালুমিনিয়াম তৈজসপত্রের উৎপাদন খরচ বেশি। এখন বিদ্যুতের সমস্যা কাটলেও গ্যাসের সমস্যা কাটেনি। দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় চট্টগ্রামে এই কারখানা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেক উদ্যোক্তা।
উদ্যোক্তাদের মতে, তৈজসপত্রের বাজারে অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের পাশাপাশি স্টেইনলেস স্টিল, মেলামিন, সিরামিক, কাচ কিংবা প্লাস্টিক পণ্যের প্রতিযোগিতা চলছে। এরপরও রান্নাঘরে পাতিল, কড়াই, কলসসহ অন্তত ২০ ধরনের অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের চাহিদা আছে।
উদ্যোক্তারা জানান, স্বল্প পুঁজিতে অর্থাৎ ৩-৪ লাখ টাকায় ছোট কারখানা গড়ে তোলার সুযোগ থাকায় ২০০০ সাল পর্যন্ত অনেক উদ্যোক্তা এই খাতে যুক্ত হয়েছিলেন। ২০১০ সালের পর থেকে স্টেইনলেস স্টিল, প্লাস্টিক, সিরামিকসহ গৃহস্থালি পণ্যে বৈচিত্র্য বাড়তে থাকায় অ্যালুমিনিয়াম তৈজসপত্রের ব্যবহার কমে যায়।
উদ্যোক্তারা জানান, পাকিস্তানের পাঞ্জাবের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শফি সিন্ধু ‘খলিল মেটাল’ নামে চট্টগ্রামের মোহাম্মদপুরে প্রথম অ্যালুমিনিয়াম কারখানা গড়ে তোলেন ১৯৫৮ সালের দিকে। আবার অনেক উদ্যোক্তা মনে করেন, মির্জাপুলের গোড়ায় হক অ্যালুমিনিয়াম কারখানা প্রথম চালু হয়, যেটির উদ্যোক্তা ছিলেন ফেনীর হক সাহেব। এরপর সিরাজ অ্যালুমিনিয়াম এবং পরে ভূঁইয়া অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কস চালু হয়। এসব কারখানা কাছাকাছি সময়ে চালু হয়। ১৯৬৩ সালে শফি সিন্ধুর কারখানা কিনে নেন খলিলুর রহমান নামে এক উদ্যোক্তা। নাম দেন ‘সেকান্দর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ’। শুরুর দিকে কারখানার সংখ্যা গুটি কয়েক থাকলেও এই শিল্পে জোয়ার আসে ১৯৮৪-৮৫ সালের দিকে। অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্রের চাহিদা বাড়তে থাকায় অনেক উদ্যোক্তাই কারখানা গড়ে তুলেছিলেন তখন। এখন কমছে।