পিছিয়ে পড়ছে দেশীয় মোবাইল ব্র্যান্ড

>
• সাশ্রয়ী মূল্য ও আগ্রাসী বিপণনের কারণে চীনের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোনের বাজার বাড়ছে বাংলাদেশে।
• তিন বছরে বেড়েছে ১৫০ গুণ।

বাংলাদেশের মোবাইল ফোনের বাজারে ক্রমেই বাড়ছে চীনা ব্র্যান্ডের আধিপত্য। গত দুই বছরের ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালেও স্মার্টফোনের বাজারে চীনের ব্র্যান্ডগুলো সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এতে বেশ খানিকটা বাজার হারিয়েছে দেশীয় মোবাইল ফোনের ব্র্যান্ডগুলো।

মোবাইল ফোন খাত-সংশ্লিষ্টদের মতে, সারা বিশ্বে এখন যত মোবাইল ফোন উৎপাদিত হয় তার ৮৫ শতাংশই তৈরি হয় চীনে। উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থায় চীনের যে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, সেটি এখন আর কোনো দেশের নেই। এ কারণে হুয়াওয়ে, অপো, শাওমি, ভিভো, টেকনোর মতো ব্র্যান্ডের বৈশ্বিক অবস্থান ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। সাশ্রয়ী মূল্য ও ব্র্যান্ডের নিশ্চয়তা থাকায় বাংলাদেশের ক্রেতারাও এসব মোবাইল ফোন কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন।

চীনা মোবাইল ব্র্যান্ডের সাফল্যের আরেকটি বড় কারণ আগ্রাসী বিপণন কৌশল। পণ্য বিপণন ও প্রচারণায় চীনের ব্র্যান্ডগুলো বড় ধরনের বিনিয়োগ করছে। এ ছাড়া পণ্যের মান উন্নয়নে গবেষণায়ও ধারাবাহিক বিনিয়োগ করছে এসব ব্র্যান্ড।

মোবাইল ফোন আমদানিকারকদের হিসাবে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে মোট ৮১ লাখ ইউনিট স্মার্টফোন আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে চীনা ব্র্যান্ডের আমদানি ছিল ১৮ লাখ। ২০১৬ সালে এ আমদানির পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৪০ হাজার, ২০১৫ সালে ১ লাখ ৬০ হাজার ও ২০১৪ সালে মাত্র ১২ হাজার। অর্থাৎ মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে চীনের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্মার্টফোনের বাজার বেড়েছে ১৫০ গুণ।

চীনা ব্র্যান্ডের এমন প্রবৃদ্ধিতে দেশীয় ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন আমদানি ২০১৭ সালে কমে গেছে। গত বছর সিম্ফনির মতো স্থানীয় ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন আমদানি হয়েছে ৫০ লাখ, যা ২০১৬ সালে ছিল ৫৭ লাখ। একইভাবে আমদানি কমেছে বহুজাতিক বিভিন্ন স্মার্টফোন ব্র্যান্ডের। ২০১৭ সালে এসব ব্র্যান্ডের আমদানির পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ১০ হাজার, যা ২০১৬ সালে ছিল ১৩ লাখ ৪৬ হাজার।

স্মার্টফোন ও সাধারণ ফোন মিলিয়ে মোবাইল ফোনের বাজারের আকার এখন কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে স্মার্টফোনের বাজার ৭ হাজার কোটি টাকার। ২০১২ সাল থেকে দেশে স্মার্টফোনের বিক্রি শুরু হয়। সে বছর স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছিল ৩ লাখ। সেটি ৫ বছরে ৩০ গুণের বেশি বেড়েছে।

চীনা ব্র্যান্ডের মধ্যে বাংলাদেশের বাজারে স্মার্টফোন বিক্রিতে এগিয়ে আছে হুয়াওয়ে। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৮ লাখ ইউনিট স্মার্টফোন আমদানি করেছে। বর্তমানে দেশের বাজারে হুয়াওয়ের ১২টি মডেলের ফোরজি স্মার্টফোন রয়েছে। এগুলোর দাম ১১ হাজার ৯৯০ টাকা থেকে ৮৩ হাজার ৯০০ টাকার মধ্যে। হুয়াওয়ে কনজিউমার বিজনেস বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর জিয়াউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের স্মার্টফোনের বাজারে সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে হুয়াওয়ে। গত বছর গ্রাহকদের ব্যাপক সাড়ায় হুয়াওয়ে অত্যন্ত আনন্দিত।’

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন আমদানিকারক সমিতির (বিএমপিআইএ) হিসাবে, স্মার্টফোন ও সাধারণ ফোন মিলিয়ে মোবাইল ফোনের বাজারের আকার ১০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে স্মার্টফোনের বাজার ৭ হাজার কোটি টাকার।

সিম্ফনি মোবাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিএমপিআইএর মহাসচিব জাকারিয়া শহীদ বলেন, ‘২০১৭ সালে চীনা কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করলেও আমাদের ব্যবসা প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। তবে শিগগিরই দেশেই মোবাইল ফোন সংযোজন ও উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে সিম্ফনি। এতে সিম্ফনির মতো স্থানীয় ব্র্যান্ডের অবস্থান বাজারে শক্তিশালী হবে।’

ইতিমধ্যে গাজীপুরের চন্দ্রায় নিজস্ব কারখানায় মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজন শুরু করেছে ওয়ালটন। আরও কয়েকটি স্থানীয় ব্র্যান্ডের দেশে মোবাইল সংযোজনের পরিকল্পনা রয়েছে।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোও চীনের সঙ্গে পেরে উঠতে পারছে না। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ভারতের মোবাইল ফোন বাজারের ৫৩ শতাংশ চীনা ব্র্যান্ডের দখলে রয়েছে। মাইক্রোম্যাক্স, লাভা, ইনটেক্স ও কার্বনের মতো স্থানীয় ভারতীয় ব্র্যান্ডের দখলে রয়েছে বাজারের মাত্র সাড়ে ১২ শতাংশ। স্থানীয় ব্র্যান্ডের ব্যবসা রক্ষায় ভারত সরকার বিদেশ থেকে মোবাইল ফোন আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েও চীনা ব্র্যান্ডের আধিপত্য ঠেকাতে পারেনি। বাজার ধরতে শাওমি, ভিভো, লেনোভো, অপো, হুয়াওয়ের মতো চীনা ব্র্যান্ডগুলো এখন ভারতেই মোবাইল ফোনের উৎপাদন ও সংযোজন কারখানা করেছে।

টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ গবেষক আবু সাইদ খান প্রথম আলোকে বলেন, মোবাইল ফোন খুবই
মূল্য সংবেদনশীল ভোগ্যপণ্য। তবে শুধু কম দামে মোবাইল বিক্রি করাই যথেষ্ট নয়, এখানে গ্রাহক অভিজ্ঞতাও গুরুত্বপূর্ণ।