ব্যাংকে অর্থসংকট

>
  • চাপের মুখে অর্থনীতি।
  • বাড়ছে ডলারের দাম ও সুদহার।
  • ঋণ পাচ্ছে না গ্রাহক।
  • আমানত পেতে দৌড়ঝাঁপ।

দেশের ৩৩২ শাখার মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল)। এই ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপকেরা অনুমোদন হওয়া ঋণ যেকোনো সময় বিতরণ করতে পারতেন। তারল্যসংকট তৈরি হওয়ায় গত নভেম্বরে শাখা ব্যবস্থাপকদের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে বেসরকারি খাতের দেশের সবচেয়ে বড় এ ব্যাংকটি। ৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ বিতরণে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন লাগবে—এমন নির্দেশনা জারি করেছে।

এ অবস্থা শুধু ইসলামী ব্যাংকের নয়, বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকই তারল্যসংকটে পড়ে ঋণ বিতরণ সংকুচিত করেছে, সুদহার বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করছে। ফলে বেড়ে গেছে আমানত ও ঋণ উভয়ের সুদহার। তবে সরকারি ব্যাংকগুলোয় ঋণ দেওয়ার পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে, এরপরও অনেকেই বাড়াচ্ছে সুদহার।

এদিকে আমদানি চাপ বেড়ে যাওয়ায় ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এতে বেড়ে গেছে ডলারের দাম। ব্যাংকগুলো নগদ টাকা দিয়ে প্রতিনিয়ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে। এতে এক দিকে টাকার ওপর চাপ পড়ছে, আর ডলারের দাম বাড়ার ফলে আমদানি খরচও বেড়ে গেছে।

বেসরকারি ব্যাংক সূত্র বলছে, গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা তোলার একটা চাপ রয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মেয়াদি আমানত সরিয়ে নিতে চাইছে। এ কারণেই তারল্যের ওপর চাপ বাড়ছে। সামনের দিনগুলোতে ডলারের সংকট আরও তীব্র হবে, যার প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি ব্যাংকে ভালোই টাকা আছে। তারল্য কম বেসরকারি খাতের ব্যাংকে। আবার এটাও বলা যেতে পারে, অনেকে ঋণ নিতে চাইছে না। নির্বাচনী বছরে এটা সাধারণত হয়, যেমন হয় বাজেটের আগে আগে।’

যদিও দেশের সবচেয়ে পুরোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আনোয়ার গ্রুপের অন্যতম পরিচালক হোসেন খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনের প্রভাবটা সাধারণত বছরের শেষ দিকে দেখা গেলেও এবার বছরের শুরুতেই ব্যাংকের ঋণের একটা সমস্যা তৈরি হলো। ব্যাংকে তারল্যসংকট দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের বছরে ব্যবসায়ীরা মানসিকভাবে একটু রক্ষণশীল হয়ে যান। একটু সাশ্রয়ী থাকার চেষ্টা করেন।’

বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় টাকার সংকটের বড় অংশই পূরণ করছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টাকা ধার দিচ্ছে ব্যাংকটি। বিষয়টি জানিয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব বেসরকারি ব্যাংকই আমাদের থেকে টাকা ধার নিচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে আমরাও নিয়মের মধ্যে যতটা সম্ভব টাকা দিচ্ছি। বেসরকারি ব্যাংকে ঋণ না পেয়ে এখন আমাদের কাছে প্রচুর আবেদন আসছে।’

আমানত পেতে দৌড়ঝাঁপ

২০১২ সালে আমানতের ওপর সুদ ছিল সাড়ে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে আমানতের গড় সুদহার নেমে আসে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদহার কমে হয় ৫ দশমিক ২২ শতাংশ। তবে এখন বেশির ভাগ ব্যাংক ৯ থেকে ১৩ শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। বেসরকারি সব ব্যাংকের পাশাপাশি রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংকও সম্প্রতি সুদহার বাড়িয়েছে। অথচ এক বছর আগেও আমানতকারীদের নিরুৎসাহিত করছিল কিছু ব্যাংক। আর এখন অধিকাংশ ব্যাংকই আমানত সংগ্রহের লক্ষ্য বেঁধে দিয়ে কর্মকর্তাদের মাঠে নামিয়েছে।

সুদহার বাড়ায় আমানতকারীরা এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ছুটছেন। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীরাও বড় অঙ্কের আমানত তুলে ফেলছে। ফারমার্স ব্যাংক থেকে জলবায়ু তহবিলের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ফেরত না পাওয়ায় অনেকে আতঙ্কে বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফেলছেন। অধিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের দিকেই ঝুঁকছে।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে ভালো অঙ্কের বিনিয়োগযোগ্য আমানত রয়েছে। ভালো প্রকল্প না মেলায় অর্থায়ন করা যাচ্ছে না।

ঋণ পাচ্ছে না গ্রাহক, বাড়ছে সুদ

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০টি ব্যাংকে তারল্য বা নগদ টাকার সংকট চলছে। সব ব্যাংক নতুন করে ঋণ না দিয়ে আদায়ের চেষ্টা করছে। নতুন করে আমানত সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সীমা সমন্বয়ের চেষ্টা করছে। এতে আমানতের সুদহারের পাশাপাশি ঋণের সুদও বেড়ে গেছে। গত বছরও অনেক গ্রাহক এক অঙ্কের সুদে ঋণ পেলেও এখন তা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে।

যদিও প্রধানমন্ত্রী গত সপ্তাহে আওয়ামী লীগের যৌথসভায় ঋণের সুদ হার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত সুদ হারে বড় ধরনের পরিবর্তন আসেনি। 

ব্যাংকগুলো স্বল্প মেয়াদের টাকার প্রয়োজন হলে কল মানি থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। সম্প্রতি টাকার সংকট তৈরি হওয়ায় কল মানিতেও সুদহার বাড়তে শুরু করেছে। এখন আন্তব্যাংকে গড়ে ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ সুদে লেনদেন হচ্ছে; ২০১৫ সালের নভেম্বরের পর যা সর্বোচ্চ।

আমানতের তুলনায় ঋণে বেশি প্রবৃদ্ধির ফলে এমনিতেই অনেক ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার ওপরে চলে গেছে। এর মধ্যে গত ৩০ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এডিআর কমিয়ে প্রচলিত ধারার ব্যাংকের জন্য সাড়ে ৮৩ ও ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৯ শতাংশ করেছে। এ সীমা সমন্বয়ে প্রথম দিকে জুন পর্যন্ত সময় দিলেও এখন তা বাড়িয়ে ডিসেম্বর করা হয়েছে।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ হালিম চৌধুরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এখন বড় গ্রুপগুলো চাইলেই আর ব্যাংকঋণ পাচ্ছে না। ব্যাংক অনেক বুঝেশুনে অর্থায়ন করছে। আমদানি-রপ্তানিতে অসামঞ্জস্যের কারণেই মূলত তারল্যসংকট তৈরি হয়েছে। টাকা দিয়ে ডলার কিনে আমদানি দায় শোধ করতে হচ্ছে। সহজেই এ সংকট কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। অনেক বড় ব্যাংক কাউকে তোয়াক্কা না করে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করে সংকট দীর্ঘায়িত করছে।

সংকটে বাড়ছে ডলারের দাম

চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম রয়েছে ডলারের। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, আমদানি বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এতে রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এবার (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস) এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল ছাড়িয়ে গেছে ১৫৬ কোটি ডলার। এর আগের দুই মাসে (নভেম্বর-ডিসেম্বর) এই দায় ছিল ১১৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৩ হাজার ৩৩৬ কোটি ডলার। সেখান থেকে আকুর বিল পরিশোধের পর তা কমে হয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমদানি ঋণপত্র বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন গত নভেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সোনালী ব্যাংকে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলে। এ কারণে নভেম্বরেই ঋণপত্র খোলার পরিমাণ বেড়ে হয় ১ হাজার ৬৩৩ কোটি ডলার। এরপরই ডলার-সংকট প্রকট হয়।

ডলার-সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ডলার বিক্রি করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডলার কিনেছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। ফলে এক বছরে প্রতি ডলারের দাম ৭৮ থেকে ৮৩ টাকায় উঠেছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ডলারের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এটা শিগগিরই কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। এভাবে চলতে থাকলে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। কারণ, ব্যবহার্য সামগ্রীর কাঁচামালের বড় অংশই আমদানি করতে হয়। আর এতে বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়।