সংকটের কারণে বোনাস লভ্যাংশ

>
  • খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে না পেরে অনেক ব্যাংক বিলম্বিত সঞ্চিতির সুবিধা নিয়েছে।
  •  বাংলাদেশ ব্যাংক জুড়ে দিয়েছে শর্ত।

ব্যাংক খাতের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার প্রভাব পড়েছে মুনাফায়। আর এ কারণে ২০১৭ সালের আর্থিক হিসাব চূড়ান্ত করতে গিয়ে ঋণের বিপরীতে চাহিদামতো নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে পারেনি কয়েকটি ব্যাংক। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মতো বেসরকারি খাতের কমপক্ষে ১০ ব্যাংকের পরিস্থিতি এ রকম। ২০১৭ সালের সঞ্চিতি ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ধাপে ধাপে সংরক্ষণ করা হবে, এমন শর্তে হিসাব চূড়ান্ত করেছে এসব ব্যাংক। বিশেষ ব্যবস্থায় হিসাব চূড়ান্ত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদনও দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া শর্তানুযায়ী, সঞ্চিতির অর্থ সংরক্ষণ করতে না পারায় শেয়ারধারীদের নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি এসব ব্যাংক। ফলে বেশির ভাগ ব্যাংককে বোনাস লভ্যাংশ দিয়ে শেয়ারধারীদের তুষ্ট করতে হয়েছে।

এদিকে আর্থিক অবস্থার চরম অবনতির কারণে শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি এবি ব্যাংক। ফলে শেয়ারবাজারে এটি নিম্নমানের কোম্পানি হিসেবে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত হয়েছে।

জানা গেছে, ব্যাংকটির অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত না আসায় ও বিতরণকৃত ঋণের বড় অংশ খেলাপি হয়ে পড়ায় বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে ২০১৭ সালে মুনাফা কমে হয় মাত্র ৫ কোটি টাকা। অথচ ২০১৬ সালেও ১৫১ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি।

তবে ব্যতিক্রমও আছে, কোনো বিশেষ সুবিধা না নিয়েও সর্বোচ্চ নিট মুনাফা অর্জনকারী ব্র্যাক ব্যাংক ও ২০১৭ সালে দ্বিগুণ মুনাফা অর্জনকারী আইএফআইসি ব্যাংক শেয়ারধারীদের বোনাস লভ্যাংশ দেয়। ব্র্যাক ব্যাংক ২৫ শতাংশ ও আইএফআইসি ব্যাংক ১২ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেয়।

এ বিষয়ে আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে নগদ লভ্যাংশের চেয়ে বোনাস দেওয়াই শ্রেয়। এতে করে ব্যাংক থেকে কোনো টাকা বের হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো বিধিনিষেধ নয়, আমরা নিজেরাই নগদের পরিবর্তে বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছি।’

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক ২০১৭ সালের জন্য শেয়ারধারীদের ৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ব্যাংকটি ২০১৭ সালে ২৪৬ কোটি টাকা নিট মুনাফা করে। ট্রাস্ট ও উত্তরা ব্যাংক ২০ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দেয়। ব্যাংক দুটি যথাক্রমে ১৭৫ কোটি ও ১৫৩ কোটি টাকা নিট মুনাফা করে।

অন্যদিকে ন্যাশনাল ব্যাংক ৪৭৯ কোটি টাকা নিট মুনাফা করলেও নিয়ম মেনে আর্থিক হিসাব চূড়ান্ত করতে পারেনি। ২০১৭ সালে মন্দ ঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ সঞ্চিতি রাখার নিয়ম ছিল, তা রাখতে পারেনি ব্যাংকটি। পরের দুই বছরে এ সঞ্চিতি রাখা হবে, এমন শর্তে হিসাব চূড়ান্ত করার অনুমতি পায় ব্যাংকটি। এ জন্য শেয়ারধারীদের কোনো নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি ন্যাশনাল ব্যাংক। ২০১৭ সালের জন্য ২৪ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে ব্যাংকটি। খেলাপি ঋণের কারণে যে পরিমাণ সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়েছিল, তা সংরক্ষণ করতে হলে ব্যাংকটির মুনাফার হিসাবই শূন্য হয়ে যেত।

ব্যাংক এশিয়া ২১১ কোটি টাকা নিট মুনাফা করলেও সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিতে হয়েছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেলাপির তালিকায় নিজেদের নাম না তুলতে অনেকে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়েছেন। অথচ এসব ঋণের বিপরীতে আমাদের পর্যাপ্ত সঞ্চিতি রাখতে হচ্ছে। এ কারণে সব সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা যায়নি।’

ঢাকা ব্যাংক ১৬১ কোটি নিট মুনাফা করে সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেয়। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ২০১২-১৩ সালে খারাপ হওয়া ঋণগুলো এখন অবলোপন হচ্ছে। এর বিপরীতে শতভাগ সঞ্চিতি রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে বিভিন্ন ব্যাংককে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে বিলম্বিত সুবিধা নিতে হচ্ছে।

ঢাকা ব্যাংকের বিষয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নতুন করে ঋণ সেভাবে খেলাপি হয়নি। তবে ঋণ অবলোপন করে আর্থিক প্রতিবেদন ঠিক করা হচ্ছে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারন বিনিয়োগকারীদের কারণে ব্যাংকগুলোকে কয়েক বছর ধরে এমন সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এরপরও ব্যাংকগুলো নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পারছে না। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো হিসাবের মুলনীতিকে পাশ কাটাচ্ছে।