বিদেশি বিনিয়োগের নিবন্ধন ব্যাপক, প্রকৃত বিনিয়োগ কমেছে

>• ২০১৭ সালে নিবন্ধন হয়েছে ১০৪৭ কোটি ডলারের বিনিয়োগ
• প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ২১৫ কোটি ডলারের।
• আগের বছরের চেয়ে ৭.৭৬ শতাংশ কম বিনিয়োগ এসেছে।


দেশে বিদেশি বিনিয়োগের নিবন্ধন ব্যাপকভাবে বাড়লেও প্রকৃত বিনিয়োগ কমেছে। ২০১৭ সালে বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার বিনিয়োগ আগের বছরের চেয়ে কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে এ দেশে ২১৫ কোটি ডলারের প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ কম। একই সময়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছে ১ হাজার ৪৭ কোটি ডলারের বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে।

বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে তাকে প্রকল্পের নিবন্ধন করাতে হয়। এটি প্রকৃত বিনিয়োগ নয়। প্রতিষ্ঠানটি যখন অর্থ এনে কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করে, সেটিই প্রকৃত বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হয়।

বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করা, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, অবকাঠামো উন্নয়নের নানা উদ্যোগ এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যেই দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমল। এমনিতেই বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত হারের চেয়ে কম পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ পায়। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়ায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বিনিয়োগের পরিমাণ ২৩ শতাংশে আটকে আছে। বিনিয়োগ না হলে দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি হয় না। তাই রপ্তানি বৃদ্ধি, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে বিদেশি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালে দেশে মোট ২৬৮ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশিরা ৫৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন। এতে প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ২১৫ কোটি ডলার। এ অর্থের মধ্যে ২৫ শতাংশ বা প্রায় ৫৪ কোটি ডলার নতুন বিনিয়োগ বা মূলধন হিসেবে এসেছে। এ দেশে কর্মরত কোম্পানিগুলো তাদের আয় থেকে পুনর্বিনিয়োগ করেছে ১২৮ কোটি ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৬০ শতাংশ। বাকি ৩৩ কোটি ডলার বা ১৫ শতাংশ এসেছে আন্তকোম্পানি ঋণ হিসেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিদেশি বিনিয়োগের ধারা ঊর্ধ্বমুখী ছিল। গত সাত বছরের মধ্যে ২০১৪ সালে বিদেশি বিনিয়োগ সামান্য কিছুটা কমে যায়। ওই বছর নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ছিল ব্যাপক পরিমাণে। সে তুলনায় ২০১৭ সালে পরিস্থিতি ছিল বিনিয়োগের উপযোগী।

এ বছর বিনিয়োগ কেন কমল জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম বলেন, একটি বিনিয়োগ প্রস্তাব এলে সেটি বাস্তব রূপ পেতে কয়েক বছর সময় লাগে। গত বছর যেসব বিনিয়োগ হয়েছে, সেগুলোর নিবন্ধন হয়েছিল কয়েক বছর আগে। তখন নিবন্ধনের পরিমাণই কম ছিল। তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে দেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে। আগামী কয়েক বছরে এর সুফল পাওয়া যাবে। আশা করছি আগামী বছরগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগে একটি উল্লম্ফন দেখব আমরা।’

বিডার তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরের হিসাবে দেশে বছরে হাজার কোটি ডলারের বেশি পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে। ২০১৬ সালে নিবন্ধিত হয় ১ হাজার ১৩২ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এবং ২০১৭ সালে তা দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৬ কোটি ডলার। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে এ পরিমাণ অনেক কম ছিল। ওই দুই বছরে দেশে মাত্র ১৫০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছিল।

বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকার বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস বা সহজে ব্যবসা সূচকে উন্নতির পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২১ সালে এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে কমপক্ষে ৯৯তম অবস্থানে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এ সূচকে এখন বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম। অন্যদিকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। এর মধ্যে সরকারি খাতে ছয়টির কাজ এগোচ্ছে। বেসরকারি খাতে ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে চূড়ান্ত লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে বিদেশি ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি ও ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ মুনিম গত মাসে প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের রিটার্ন বা মুনাফা অনেক বেশি। এ দেশে যেসব বহুজাতিক কোম্পানি কাজ করে, তাদের অনেকেরই শীর্ষ লাভজনক শাখা বাংলাদেশ।

তারপরও বাংলাদেশে কেন বিদেশি বিনিয়োগ কম আসে, জানতে চাইলে এফআইসিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, ‘আমরা যারা এখানে অনেক দিন ধরে কাজ করছি, তারা নানা বিষয়ে অভ্যস্ত। তবে নতুনদের জন্য বাংলাদেশে ব্যবসা করা কঠিন।’

শেহজাদ মুনিম মনে করেন, সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো সফলভাবে শেষ হলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। তবে এসবের প্রচার দরকার। দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে ‘কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং’ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।