চাই আয়বৈষম্য কমানোর বাজেট

দেশের উন্নতি হলেও সমাজে আয়বৈষম্য বাড়ছে। সে জন্য জাতীয় বাজেটে এই বৈষম্য কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
আইসিএবি-প্রথম আলোর যৌথভাবে আয়োজিত ‘কেমন চাই জাতীয় বাজেট ২০১৮-১৯’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আইসিএবি কার্যালয়ে গতকাল সোমবার এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য এম শামসুল আলম বলেন, বৈষম্য বাড়ছে ঠিক। আরও বেশি বাড়লে তা হবে ভয়ংকর বার্তা। তবে আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ধরা হচ্ছে। এটা রক্ষা করতে সরকার চেষ্টা করবে।

বিদেশে টাকা পাচার প্রসঙ্গে শামসুল আলম হতাশার সুরে বলেন, ‘ছেলেমেয়েদেরই আমরা দেশে রাখতে পারছি না। টাকা রাখব কীভাবে?’

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, দেশের যে উন্নতি হচ্ছে, তা দৃশ্যমান। কিন্তু তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে আয় বণ্টন হচ্ছে না। এতে বৈষম্য বাড়ছে।

বৈষম্য বৃদ্ধি রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ৫০ বছর ধরে বলা হচ্ছে, আয়কর আইন সহজ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা আরও জটিল হয়েছে।

আইসিএবির সভাপতি দেওয়ান নুরুল ইসলাম এবং প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম এতে স্বাগত বক্তব্য দেন। পুরো বৈঠক সঞ্চালনা করেন আইসিএবির সাবেক সভাপতি হুমায়ুন কবির।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটের মূল দর্শন হচ্ছে সম্পদের পুনর্বণ্টন। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যেই রয়েছে, সমাজে আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য বাড়ছে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ছাড়া কিছুই হবে না। অথচ আমরা শিক্ষিত বেকার তৈরি করছি।’

কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে আটটি মেয়ের মৃত্যুর উদাহরণ তুলে ধরে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘এরপর থেকে অনেকে বিদ্যালয়ে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। অর্থমন্ত্রীকে বহুবার অনুরোধ করেছি কয়েকটা ওয়াটার বাসের ব্যবস্থা করতে, বেশি টাকাও লাগবে না। কিন্তু হয়নি।’

আইসিএবির কাউন্সিল সদস্য শাহাদত হোসেন বলেন, বৈষম্যের মূল কারণ মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি। ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বাড়লেও ব্যাপক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।

বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান পোশাক খাতে কর থাকাই উচিত না বলে মনে করেন। কারণ, এ খাত বৈদেশিক মুদ্রা আনে এবং কর্মসংস্থান তৈরি করে। তিনি আগামী বাজেটকে কর্মসংস্থানমুখী করার পরামর্শ দেন।

পরিবেশদূষণ ঠেকানোর আহ্বান
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান বলেন, ‘পরিবেশদূষণে বিশ্বের ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৮ তম। ঢাকার বাতাসে কী আছে, তা জানলে আমরা নিশ্বাস নেওয়াই ছেড়ে দেব। আমরা কী খাচ্ছি, তা জানলে খাবার খাওয়াও ছেড়ে দেব। আমাদের নীতি এ রকম হয়েছে যে এক গোষ্ঠীকে দূষণ করতে দেওয়া হচ্ছে এবং তা শোধনের জন্য করদাতাদের টাকা ব্যয় করা হচ্ছে।’

পরিবেশদূষণ ঠেকানোর পরামর্শ দিয়ে বেলার প্রধান নির্বাহী বলেন, পাঁচটি খাল খননে ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার কথা শোনা যায়। দেশে যেভাবে নদী ও খাল নষ্ট করা হয়েছে, সেগুলো উদ্ধার করতে গেলে পুরো বাজেটের অর্থই লেগে যাবে।

শহরে যানজট অসহনীয় হয়ে পড়েছে এবং সুশাসনের অভাবের কারণে পরিবহন খাতের বরাদ্দের কথাও তুলতে চান না উল্লেখ করে সৈয়দা রেজওয়ানা বলেন, এক দিনে ঢাকার গুলশানে একটি সভায় যোগ দিলে ধানমন্ডিতে আরেকটি সভায় যোগ দেওয়া যায় না।

অবকাঠামো উন্নয়নে নজর দিতে হবে
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘১০টি ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্পের মধ্যে আটটির জন্য দরকার ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। অবকাঠামো দুর্বলতায় সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগও (এফডিআই) আসছে না। ভিয়েতনাম কোথায় উঠে গেছে! আমাদের এখন দৌড়ানোর দরকার, কিন্তু আমরা হাঁটছি।’

আইসিএবির কাউন্সিল সদস্য এ এফ নেসারউদ্দিন বলেন, ‘২০০ কোটি ডলারের এফডিআইয়ে আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। নীতির ধারাবাহিকতা না থাকায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া, আইন হলেও এখানে বিধি হতে সময় লাগে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) গঠিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কম সময়ে আমরা সেবা দেওয়াটা দেখতে পাচ্ছি না।’

দুর্নীতি কমানোর তাগিদ
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, মানব উন্নয়ন না হলে কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হবে না। শিক্ষা বাজেট অনেক দিন ধরেই জিডিপির ২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ দুর্নীতি ও নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে ২ শতাংশ করে জিডিপির মোট ৪ শতাংশ অপচয় হচ্ছে।

ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ বলেন, বড় ঋণখেলাপিরা বড় ব্যবসায়ী। তাঁদের কারণেই ব্যাংকের খরচ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর) যে সম্প্রতি কমানো হয়েছে, তা করা হয়েছে মূলত ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থে।

চাই প্রণোদনা
মার্চেন্ট ব্যাংকারস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ বলেন, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে ১৫, মার্চেন্ট ব্যাংককে ৩৭ দশমিক ৫ এবং ব্রোকারেজ হাউসকে ৩৫ শতাংশ কর দিতে হয়। এত বেশি পার্থক্য থাকা উচিত নয়।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতের অবকাঠামো উন্নয়ন এখন জরুরি। দুর্ভাগ্যজনক যে এ খাতে প্রতিবছর কর বাড়ানো হচ্ছে।

আইসিএবির সাবেক সভাপতি কামরুল আবেদিন বলেন, ‘শিল্প গড়া হচ্ছে শিল্পপতিদের নেশা। তাই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মুনাফা পুনর্বিনিয়োগের শর্তে করহারে ছাড় দেওয়া যেতে পারে।’