ভর্তুকিতে বরাদ্দ পদ্মা সেতু তৈরির সমান টাকা

আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। এই খাতে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বরাদ্দ ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এই বরাদ্দ ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেড়ে হচ্ছে ৩১ হাজার কোটি টাকা, যা পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয়ের সমান।

প্রকৃত দামের চেয়ে কম দামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বিক্রি করতে হবে বলে নতুন বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে বলে জানান অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তাঁদের মতে, মোট ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়ছে মূলত ওই এলএনজির কারণেই। চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে মোট বরাদ্দ বাড়বে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ।

জানতে চাইলে অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি এখনো ওই পর্যায়ে উন্নীত হয়নি যে ভর্তুকি তুলে দিতে হবে। প্রায় সব দেশেই কম-বেশি ভর্তুকি থাকে, আমাদেরও আছে।’ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে এত ভর্তুকি দিতে হবে না বলে আশা প্রকাশ করেন অর্থসচিব এবং এ বিষয়ে বর্তমান অবস্থার সংস্কারেরও পক্ষে তিনি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ খাতে বাজেট বরাদ্দ গত পাঁচ বছর খুব বেশি বাড়েনি বা কমেনি। এই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় একপ্রকার স্বস্তিতে ছিলেন অর্থমন্ত্রীও। বাজেট প্রণয়নের সময় ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে এই খাতে বরাদ্দ কমিয়ে আনার প্রবণতাই দেখা গেছে। যেমন ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৭ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমিয়ে করা হয়েছিল ২৫ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।

ভর্তুকি কম দিতে হলে সরকারের জন্য ভালো। কারণ, এই টাকাটা সরাসরি জনগণের দেওয়া করের টাকা। ভর্তুকি না দিতে হলে এই টাকা সরকার অন্য কাজে ব্যয় করতে পারত। এত দিন ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছিল প্রধানত বিদ্যুৎ, কৃষি, রপ্তানি, খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য ইত্যাদি খাতে। এবার নতুন করে দেওয়া হচ্ছে এলএনজিতে। কারণ, সরকার হিসাব করে দেখেছে, যে দামে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, সেই দামে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছে বিক্রি করলে তাঁদের পণ্য উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে। তাই গ্যাস ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার এখানে ভর্তুকি দিতে যাচ্ছে।

জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংগত কারণেই ভর্তুকি থাকবে। তবে আগামী বাজেটে এ খাতের অঙ্কটা শুনে মনে হচ্ছে পরিমাণটা একটা পদ্মা সেতু তৈরির ব্যয়ের সমান।’ তিনি ধীরে ধীরে এই ভর্তুকি কমিয়ে আনার পক্ষে বলে জানান।

এবারের বরাদ্দ বৃদ্ধি নিয়ে বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, আগামী বাজেটে এক এলএনজি খাতের জন্যই ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার মতো বরাদ্দ থাকছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বেড়ে হচ্ছে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া কৃষি খাতে এবারের চেয়ে ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, রপ্তানি প্রণোদনা খাতে ৫০০ কোটি বাড়িয়ে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে।

ভর্তুকি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকেও একধরনের সমালোচনা রয়েছে। সেটি হচ্ছে, অর্থনীতিতে ভর্তুকি বেশি দিতে হলে সরকারের ওপর আর্থিক চাপ বাড়ে। অর্থ বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তুকির পক্ষেও যুক্তি রয়েছে। যেমন ভর্তুকি না দিলে কৃষিপণ্য ও বিদ্যুতের দাম বাড়বে। আর প্রতিযোগী দেশগুলো রপ্তানিতে প্রণোদনা দেয়, বাংলাদেশ না দিলে রপ্তানি কমে যাবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে খোলাবাজারে যে কম দামে চাল বিক্রি করে সরকার, সে কারণেও ভর্তুকি রাখতে হয়।

এককভাবে মোট ভর্তুকির মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পেয়ে থাকে কৃষি খাত। কৃষকের সার, বিদ্যুৎ, কৃষি উপকরণ, উন্নতমানের বীজ কেনা বাবদ এই ভর্তুকি দেওয়া হয়। আর প্রণোদনা বেশি দেওয়া হয় পাট ও পোশাক রপ্তানি খাতে। আবার নগদ ঋণ দেওয়া হয়ে থাকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ইত্যাদি সংস্থাকে।

জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিপিসি ও পিডিবিকে দেওয়া ঋণকেও একধরনের ভর্তুকি হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। কারণ, এসব ঋণ পারতপক্ষে সরকার ফেরত পায় না এবং পরে পুরো ঋণই অনুদান, ভর্তুকি ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হয়। বেসরকারি খাত থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করার জন্য পিডিবিকে ঋণ দেয় সরকার।

পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘প্রতিবছর অ্যাডহক ভিত্তিতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। বাজেটে ভর্তুকি পাওয়া খাতগুলো চিহ্নিত বলে আমরা টাকার অঙ্কগুলো জানি। অদৃশ্য কিছু খাতেও ভর্তুকি রয়েছে, যা সরকারকে বহন করতে হয়।’ ভর্তুকি-ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনা শুধু মুখে নয়, বাস্তবে করাটা জরুরি বলে তিনি মনে করেন।