নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিতে ১২ ব্যাংক

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। গত মার্চ শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংক বড় ধরনের নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিতে পড়েছে। এর মধ্যে ৮টি বেসরকারি খাতের ব্যাংক। সব মিলিয়ে পুরো ব্যাংক খাতে এখন সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। আগে সরকারি ব্যাংকগুলোতেই এ ঘাটতি ছিল প্রকট। এখন তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকও।

বেসরকারি খাতের যেসব ব্যাংকে সঞ্চিতির ঘাটতি রয়েছে, সেগুলো হলো সোস্যাল ইসলামী, এবি, ন্যাশনাল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, আইএফআইসি, প্রিমিয়ার ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক আগে থেকেই এ তালিকায় রয়েছে। আর সঞ্চিতির ঘাটতি থাকা অপর তিন ব্যাংক হলো রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, বেসিক, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্চভিত্তিক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী সরকারি, বেসরকারি, বিদেশিসহ সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, সেগুলোর গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে আলাদা হিসাবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সে জন্য এ নিরাপত্তা সঞ্চিতির বিধান রাখা হয়েছে। ঋণের মান অনুযায়ী খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ সঞ্চিতিরও বিধান রয়েছে। ব্যাংকগুলো সঞ্চিতি রাখতে না পারায় এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ সুবিধা দিয়ে তিন বছরে তা সংরক্ষণের অনুমতি দিচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকগুলোর খারাপ অবস্থার প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন সূচকে। পরিচালকেরাই ব্যাংকগুলো খারাপ করেছেন। তাই ব্যাংকগুলোকে ভালোভাবে টিকিয়ে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।

গত মার্চ শেষে সরকারি-বেসরকারি মোট ১২টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫৯৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি সোনালী ব্যাংকের। মার্চ শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সর্ববৃহৎ এ ব্যাংকের সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। এরপরই বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ৩০৭ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ২৬৮ কোটি এবং অগ্রণী ব্যাংকের ১ হাজার ৯ কোটি টাকা।

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি ১৫৫ কোটি টাকা। অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার অনিয়ম ও পাচারের কারণে ব্যাংকটি বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। এ ছাড়া বড় গ্রাহকদের ঋণও নিয়মিত ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংকটি। ফলে ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতিও রাখতে পারছে না।

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ২০০ কোটি টাকা। এ ব্যাংকটির সংকটাবস্থা কাটাতে মালিকানার পরিবর্তন হলেও কোনো উন্নতি হয়নি। আর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার পরিবর্তনের পর সংকটে পড়েছে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক। গত মার্চ শেষে ব্যাংকটির সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৩৬ কোটি টাকা।

এ ছাড়া আইএফআইসি ব্যাংকের ঘাটতি ২৯ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১১৪ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৪০ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১১৯ কোটি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৬৭ কোটি টাকা।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন-উর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বাড়ায় চাহিদামতো সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা যায়নি। এ জন্য আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ সুযোগ নিয়েছি। পরের দুই বছর এসব সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হবে।’

এদিকে সরকারের মেয়াদ যত ঘনিয়ে আসছে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। কারণ, অনেক প্রভাবশালী ঋণ নিয়ে সময়মতো কিস্তি শোধ করছে না। ফলে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ দিনকে দিন শুধুই বাড়ছে। আর ঋণের টাকা ফেরত না আসায় ব্যাংকগুলো পড়েছে অর্থসংকটে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ২২ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। আর ২০১৭ সালের মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এ বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের সঙ্গে ৪৮ হাজার ১৯২ কোটি টাকার অবলোপন যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো।