এশিয়ার অর্থনীতিতে উল্টো বাঁক

বাণিজ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঝুঁকি নাজুক করে দিচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতিকে। ছবি: রয়টার্স
বাণিজ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঝুঁকি নাজুক করে দিচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতিকে। ছবি: রয়টার্স

হঠাৎ করেই কালো মেঘে ছেয়ে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি। বাণিজ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঝুঁকি কতটা নাজুক করে দিচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতিকে? কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো সংস্থার বিশ্লেষকদের। বিশ্লেষকেরা বলছেন, আরেকটি মহামন্দার দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব অর্থনীতি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে এশিয়ার দেশগুলো।

সম্প্রতি বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বিশ্ব অর্থনীতির শঙ্কার কয়েকটি দিক তুলে ধরা হয়। বিশ্ব প্রবৃদ্ধি কমছে আর ঝুঁকির রেখা সবচেয়ে ঊর্ধ্বমুখী এশিয়ার অর্থনীতির দিকে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানাচ্ছে, চলতি বছর বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৭ শতাংশ হবে। অথচ কয়েক মাস আগেই ৩ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রাক্কলন করেছিল আইএমএফ। কারণটা হলো, ২০১৮ সালের শেষ দিকে এসে বিশ্ব অর্থনীতি যেন হঠাৎ করেই উল্টো বাঁক নিয়েছে। সম্প্রতি সারা বিশ্বের সব কটি শেয়ারবাজার দ্বিতীয়বারের মতো বড় ধরনের বিপর্যয় দেখেছে। ধীর প্রবৃদ্ধি ও যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর মুদ্রানীতিকে এর কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মুদ্রানীতিতে বারবার সুদের হার বাড়ানোর কারণে বিভিন্ন মুদ্রার বিপরীতে শক্তিশালী হচ্ছে মার্কিন ডলার। এর প্রভাবে অন্য দেশগুলোর অর্থনীতিতে একটা বড় চাপ পড়ছে। যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ডলারের ঋণ বেশি, তাদের ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানের বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।

এমন পরিস্থিতিতে আসলে ঝুঁকিতে রয়েছে কারা? বিভিন্ন বিশ্লেষণে তুরস্ক ও আর্জেন্টিনার কথা বলা হচ্ছে। তুরস্কের মুদ্রার দাম কমেছে ব্যাপক। স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। অন্যদিকে ৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে আর্জেন্টিনা।

ঝুঁকিপূর্ণ দেশের কাতারে প্রথমেই রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। ছবি: রয়টার্স
ঝুঁকিপূর্ণ দেশের কাতারে প্রথমেই রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। ছবি: রয়টার্স

আইএমএফ মনে করছে, কেবল ইউরোপ বা লাতিন দেশ নয়, ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে এশিয়ার দেশগুলোও। বিশেষ করে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো। সম্প্রতি এই দুটি দেশের মুদ্রার মান কমেছে রেকর্ড পরিমাণ। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে দুর্বলতা থাকলেও বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ওই সব দেশ, যারা ইতিমধ্যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবে আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে ধীরে ধীরে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে আইএমএফ।

ঝুঁকিপূর্ণ দেশের কাতারে প্রথমেই রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত দেশটি ইতিমধ্যে মুদ্রার মান কমেছে ব্যাপক। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রকে দুর্যোগ সংকট কাটিয়ে উঠতে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংকট মোকাবিলায় আইএমএফের কাছেও সহায়তা চেয়েছে তারা। এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ সহায়তা চেয়েছে আইএমএফের কাছে। সদ্য দায়িত্ব নেওয়া ইমরান খানের সরকার পাকিস্তানকে বাঁচাতে আইএমএফের কাছে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের ঋণ মওকুফ চেয়েছে।

এই বিষয়ের সঙ্গে ১৯৯৭ সালের অর্থনৈতিক শঙ্কার একটা মিল পাওয়া যায়। ১৯৯৭ সালের এশিয়ার বাজারে মুদ্রা–সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, যা ‘এশিয়ান ক্রাইসিস’ নামে পরিচিত। সে সময় এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল।

ক্রয় ক্ষমতার মানদণ্ডে ১৯৯২ সালে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপকে ধরে ফেলে। এ অঞ্চলের আকর্ষণীয় উন্নয়নকে তখন ‘এশিয়ার মিরাকল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, হংকং ও দক্ষিণ কোরিয়াকে বলা হতো ‘এশিয়ার বাঘ’ বা ‘এশিয়ান টাইগার’। তবে বেশি দিন টাইগার অর্থনীতিগুলো শক্তি দেখাতে পারেনি। ১৯৯৭ সালে জুনে এশিয়ার বাজারে মুদ্রা–সংকটের সৃষ্টি হয়। এর সূচনা হয় প্রথমে থাইল্যান্ডে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে থাইল্যান্ড। এ সময় দেশটির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ শতাংশের কাছাকাছি। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার করপোরেশনগুলো বিদেশ থেকে ইচ্ছামতো ঋণ নিতে থাকে প্রধানত ডলারে সুদের হার অভ্যন্তরীণ ঋণে সুদের হারের তুলনায় কম থাকায়। এ ছাড়া থাই সরকারও ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান বাড়াতে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। ফলে ফাঁপা একটা অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এশিয়াজুড়েই বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান কমে যায়। ধস নামে পুঁজিবাজারে, আমদানি আয় এবং সরকারি উত্থান হ্রাস পায়। এ ছাড়া কোম্পানিগুলো ঋণের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। মুদ্রা বিনিময়ের ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে ভাবেনি তারা। ধারণা করেছিল, ঋণ নেওয়ার সময় যেমন ছিল, পরিশোধের সময়ও ডলারের তুলনামূলক মান তেমনই থাকবে। এটিই ছিল ভুল।

মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধই বিশ্ব অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করছে। ছবি: রয়টার্স
মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধই বিশ্ব অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করছে। ছবি: রয়টার্স

২০১৮ সালে এসে ঝুঁকি হয়তো অত দূর যাবে না। তবে বিপদমুক্ত বলা যাবে না। মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধই এর অন্যতম কারণ। দেশ দুটি একে অন্যকে ঘায়েল করতে শুল্ক আরোপের পন্থা নিয়েছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত আটবার সুদহার বাড়িয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। ফলে বিভিন্ন মুদ্রার বিপরীতে শক্তিশালী হচ্ছে ডলার। চীনের মুদ্রা ইউয়ানের মূল্য অল্প কয়েক দিনের মধ্যে ৯ শতাংশ কমেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত সপ্তাহে মুদ্রানীতি শিথিল করেছে চীন। তবে এরপরও যদি চীনের মুদ্রার দাম পড়ে যায়, তাহলে এশিয়ার ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। এশিয়ার বেশির ভাগ দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হলো চীন। তাই যদি চীনের মুদ্রার মান কমে, তাহলে তা এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মুদ্রার ওপর চাপ ফেলে। এতে ওই সব দেশের পণ্য চীনা পণ্যের চেয়ে দামি হয়ে পড়ে। আর এটাই ঝুঁকির বিষয়।

আইএমএফ মনে করছে, বাণিজ্যযুদ্ধে পিছিয়ে আছে চীনই। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুটি দেশই তাদের প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাসে কাটছাঁট করলেও চীনের অবস্থা বেশি খারাপ। আইএমএফ বলছে, চলতি বছরে চীনের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে পরের বছর তা কমে হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। সংস্থাটি মনে করছে, বাণিজ্যযুদ্ধের এই পরিস্থিতে চীনের প্রবৃদ্ধি না বাড়লে এশিয়ার অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আইএমএফের এই বক্তব্যের সঙ্গে বিশ্লেষকদের বক্তব্যের একটা প্যারাডক্স তৈরি হয়েছে। কারণ, বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাণিজ্যযুদ্ধের ঝুঁকি মোকাবিলায় চীনের জন্য একটি পথ হতে পারে মুদ্রার অবমূল্যায়ন। আর আইএমএফ এক বিবৃতিতে জানায়, প্রতিযোগিতামূলক অবমূল্যায়ন থেকে চীনের বিরত থাকা উচিত এবং ‘প্রতিযোগিতামূলক উদ্দেশ্যে’ বিনিময় হার না কমানোই ভালো। অবশ্য এশিয়ার জন্য আশার বিষয় হলো আইএমএফের এই বিবৃতিতে সম্মতি জানিয়েছে চীন। যদিও ইতিমধ্যে চলতি বছরে ১০ শতাংশ মান হারিয়েছে চীনের মুদ্রা। আরও দাম হারাবে ইউয়ান—এমনটা আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, চীন তার মুদ্রাবাজার ধরে রাখতে কী পদক্ষেপ নেয়।