আড়ংয়ের মুনাফা ব্যয় হয় দরিদ্র মানুষের কল্যাণে

তামারা হাসান আবেদ
তামারা হাসান আবেদ
>

দেশে দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নিয়ে চার দশক আগে যাত্রা শুরু করে আড়ং। ঐতিহ্য, নান্দনিকতা ও আধুনিক ব্যবসা-কৌশলের সঙ্গে মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের দর্শন আড়ংকে পরিণত করেছে একটি অনন্য ব্র্যান্ডে, যেটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। আড়ংয়ের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এর পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া, উৎপাদনকারীদের ন্যায্যমূল্য দেওয়া, প্রতিষ্ঠানের মালিকানা, মুনাফা, ব্যবসার ক্ষেত্রে সমস্যা ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক তামারা হাসান আবেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহমেদ। 

প্রথম আলো: ১৯৭৮ সালে আড়ং যাত্রা শুরু করে। এত দিনে ব্যবসার বিস্তৃতি কতটুকু হলো?

তামারা আবেদ: দেশে আমাদের এখন ২০টি আউটলেট। এসব আউটলেটে আমরা ১০০ ধরনের বেশি পোশাক ও লাইফস্টাইল পণ্য বিক্রি করি। আর নকশার কথা যদি বলেন, সেটা আসলে অগণিত। ২০১৭ সালে আমাদের পণ্য বিক্রির পরিমাণ ছিল ৮৫০ কোটি টাকা। বিক্রির পরিমাণ বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। নতুন করে আমরা আগস্ট মাসে ‘তাগা ম্যান’ নামের একটি ব্র্যান্ড চালু করেছি, যেটি পুরুষের পোশাক বিক্রি করছে। এর একটি আউটলেট খোলা হয়েছে ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে। এ হিসাবে আমাদের আউটলেটের সংখ্যা ২১টি বলতে পারেন। তবে আমাদের লক্ষ্য কিন্তু নারীদের কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও দেশের কারুশিল্পকে এগিয়ে নেওয়া।

প্রথম আলো: আমি সে প্রসঙ্গেই আসছি। আপনি যদি আড়ংয়ের শুরুর গল্পটা বলেন, কেন ও কীভাবে আড়ং যাত্রা শুরু করেছিল?

তামারা আবেদ: স্যার ফজলে হাসান আবেদের হাতে ১৯৭২ সালে ব্র্যাকের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৬ সালে দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্পের পণ্য তৈরি শুরু হয়। শুরুতে এসব পণ্য ঢাকার বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করা হতো। ব্র্যাক দেখল, দোকানমালিকেরা পণ্য বিক্রি শেষ করার আগে হস্তশিল্পীদের পাওনা দিতেন না। এতে নারীদের পাওনা পেতে দীর্ঘ সময় লাগত। এখান থেকেই মূলত নিজেদের একটি বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা আসে। দুই বছর পর রাজধানীর সোবহানবাগে আড়ংয়ের একটি বিক্রয়কেন্দ্র যাত্রা শুরু করে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত আড়ংয়ের দর্শন হলো দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর কর্মসংস্থান। পণ্য তৈরি করে সরবরাহ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা মূল্য পরিশোধ করি। আড়ংয়ের কর্মীদেরও ৪৫ শতাংশ নারী।

প্রথম আলো: আড়ংয়ের পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াটি কেমন? এখন কত মানুষ আপনাদের জন্য পণ্য তৈরি করেন?

তামারা আবেদ: আড়ং একটি সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ। এর পণ্য একটি বা দুটি বড় কারখানায় তৈরি হয় না। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আড়ংয়ের পণ্য তৈরি হয়। একটি বেড়ার ঘরে একজন নারী যেমন আড়ংয়ের পণ্য তৈরি করেন, আবার ছোট ছোট কারখানায় আড়ংয়ের পণ্য তৈরি হয়। এটা একটা জটিল পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা।

প্রথম আলো: আমি যদি হাতে কারুকাজ করা একটি পাঞ্জাবির উদাহরণ দিয়ে জানতে চাই...।

তামারা আবেদ: পাঞ্জাবির কাপড়টা যদি সুতি হয়, তাহলে সেটা হয়তো নরসিংদীতে তৈরি হয়। সিল্কের হলে সেটা চাঁপাইনবাবগঞ্জে হয়। এখানে আমাদের নকশাবিদেরা নকশা করেন। কেউ নকশাটি নিয়ে যায়। সেটা নিয়ে গ্রামে গিয়ে পণ্য তৈরি করে আবার দিয়ে যায়। এমব্রয়ডারির জন্য আবার কোনো গ্রামে যায়। এভাবে একটি পোশাক তৈরির সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার মানুষ জড়িয়ে থাকেন। এরপর বিক্রির সময় দেখা গেল পোশাকটি ঢাকা, বগুড়া বা অন্য কোথাও গেছে। এভাবে বহু মানুষ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। আমরা এই যে জটিল প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করে মান ঠিক রেখে মানুষের কাছে বিক্রি করি, এর মূলে কিন্তু গ্রামীণ কর্মসংস্থান। এটা কিন্তু ব্যয়সাশ্রয়ী নয়।

প্রথম আলো: কত মানুষ আপনাদের সঙ্গে কাজ করেন, সেটা জানা হয়নি।

তামারা আবেদ: কয়েক বছর আগের হিসাব অনুযায়ী ৬৫ হাজার মানুষ আড়ংয়ের জন্য পণ্য উৎপাদন করেন। তবে আমার মনে হয়, এখন সেটা ৭৫ হাজার হবে।

প্রথম আলো: আপনাদের ওয়েবসাইটে দেখলাম, পণ্য উৎপাদনে মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে আপনারা ন্যায্যতার নীতি অনুসরণ করেন। যে নারীরা আপনাদের জন্য পণ্য উৎপাদন করেন, তাঁদের মূল্য দেওয়া হয় কোন হিসাবে?

তামারা আবেদ: একটি পণ্য তৈরিতে কত সময় লাগতে পারে, সেটা আমরা হিসাব করি। সেটার ওপর আমরা সব ধরনের খরচ ও উৎপাদকের মুনাফা যোগ করি। খরচ হিসাবের জন্য আলাদা বিভাগ আছে। এরপর উৎপাদকের সঙ্গে দর-কষাকষির ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারিত হয়। তাঁরা যদি বলেন, বাজারে দাম আরও বেশি; আমরা সেটা যাচাই করি। এসবের মাধ্যমে একটা ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে।

প্রথম আলো: আপনাদের সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জীবনমানে কী পরিবর্তন এল, সেটা কি কখনো যাচাই করেন?

তামারা আবেদ: অবশ্যই। সামাজিক কমপ্লায়েন্সের (সার্বিক মান) দিক দিয়ে আমরা খুবই সচেতন। দেশের পোশাক খাতে কমপ্লায়েন্স খুবই জরুরি। তবে সেটা নিশ্চিত করতে ক্রেতারা ব্যাপক চাপ দেন। আড়ংয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনো চাপ নেই। আমরা নিজেরাই এটা নিশ্চিত করি। সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে আমাদের একটা বিভাগ আছে। তারা নিয়মিত ৩৯টি সূচক ধরে নিরীক্ষা করে। এখানে ঘাটতি পেলে তা ঠিক করার পথনকশা তৈরি করা হয়। পথনকশা অনুযায়ী সংশোধন হচ্ছে কি না, তা নজরে রাখা হয়। কর্মস্থলে আলো-বাতাস, খাওয়ার পানি, পর্যাপ্ত শৌচাগার, ন্যায্য মজুরি, শিশুশ্রম, নিয়মিত পাওনা পরিশোধ ইত্যাদি নানা বিষয় নিরীক্ষায় দেখা হয়।

প্রথম আলো: সব মিলিয়ে দাঁড়াল যে আড়ং আর পাঁচটা প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। তাহলে এর মালিকানার ধরনটা কী? মুনাফা যেটা হয়, সেটা কারা পায়?

তামারা আবেদ: ব্র্যাক একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। ব্র্যাকের একটি প্রতিষ্ঠান হলো আড়ং। আমাদের যে মুনাফা হয়, তার অর্ধেক আমরা আড়ংয়ের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে ব্যয় করি। আর বাকি অর্ধেক ব্র‌্যাকের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় হয়। আপনি বলতে পারেন, দেশে দারিদ্র্য বিমোচনসহ ব্র্যাক যেসব উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে, তার একটি অংশ আড়ং দেয়। সেটি আবার মানুষের কাছ থেকেই আসে। আড়ংয়ে কেউ মালিক নয়। এখানে একজন অফিস সহকারী যেমন বেতনভুক্ত, আমিও তেমন বেতনভুক্ত। স্যার ফজলে হাসান আবেদও তাই। এটা আমাদের কর্মীদের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠানের অংশ ভাবার মতো একটি ভিন্ন বোধ তৈরি করে। তাঁরা জানেন, তাঁরা কেন কাজ করছেন।

প্রথম আলো: একটা কথা বলা হয় যে আড়ংয়ের পণ্যের দাম বেশি।

তামারা আবেদ: আমার মনে হয়, আড়ংয়ের পণ্যের দাম যুক্তিযুক্ত। আপনি সেখানে গেলে কোনো না কোনো কিছু কিনতে পারবেন। অনেক দামের জিনিস আছে। অবশ্যই সবাই সব জিনিস কিনতে পারবেন না। দেড় লাখ টাকার জামদানিও আড়ংয়ে মেলে। আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, সব স্তরের মানুষ কেন আড়ংয়ের পণ্য কিনতে পারবেন না। এটাকে যুক্তিসংগত বলে মনে করি না। আমরা যদি একেবারে সস্তায় পণ্য বিক্রি করি, তাহলে কারুশিল্পী, হস্তশিল্পীদের ন্যায্য মজুরি কীভাবে দেব? মান কীভাবে নিশ্চিত করব? আবার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শোরুমের খরচও মাথায় রাখতে হয়।

প্রথম আলো: বাজারের কোন অংশকে লক্ষ্য রেখে আপনারা পণ্য তৈরি করেন?

তামারা আবেদ: আমরা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাজারের কথাটি মাথায় রেখে পণ্য উৎপাদন করি।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয়। কিন্তু এ দেশে পোশাকের কোনো বৈশ্বিক ব্র্যান্ড গড়ে ওঠেনি। আড়ং কেন বাংলাদেশি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড হবে না?

তামারা আবেদ: হবে। আমরা কাজ করছি। পোশাক খাতেও অনেকে কাজ করছেন। অবশ্য আমাদের সব পণ্য বিদেশে বিক্রির মতো নয়। আবার হস্তশিল্পের পণ্যের দ্রুত উৎপাদন বাড়ানো কঠিন। সবকিছু বিবেচনা করে আমরা এগোচ্ছি।

প্রথম আলো: ব্যবসার ক্ষেত্রে কী কী প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন?

তামারা আবেদ: বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা। এ দেশে অবকাঠামো তৈরির ব্যয় অনেক বেশি। গ্রাহকের গাড়ি পার্কিং একটা বড় সমস্যা। দেশে নকশা শেখার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহু আগে হওয়া দরকার ছিল। কাপড়, সুতায় বৈচিত্র্য দরকার। কারু ও হস্তশিল্পীদের নতুন প্রজন্ম তৈরি করা দরকার। এমন নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

প্রথম আলো: শেষ প্রশ্ন। চার দশকের যাত্রার পর আড়ং নিয়ে আপনি কতটুকু সন্তুষ্ট? কত দূর যেতে চান?

তামারা আবেদ: আড়ংয়ের কারুশিল্পী, উৎপাদনকারী, কর্মী—সব মিলে যে পরিবার, তাদের অগ্রগতি দেখলে সন্তুষ্টি আসে। যাওয়ার আছে বহুদূর।