খেলাপি ঋণের নগদ আদায় কমেছে

>
  • সরকারি তিন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় কমেছে
  • একই অবস্থা বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের
  • ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান আরও খারাপ হচ্ছে
  • খেলাপি ঋণ নিয়ে নতুন করে ভাবছে বাংলাদেশ ব্যাংক
  • বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ কমাতে পন্থা খুঁজছে

সময়মতো ঋণ ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংক। খেলাপি হয়ে পড়া ঋণ বছরের পর বছর অনাদায়ি থাকছে। নির্বাচনের সময়েও খেলাপি ঋণ আদায় বাড়েনি। বরং আগের বছরের চেয়ে নগদ আদায় কমেছে। আবার নতুন করে আরও অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে। ঋণের বড় অংশ নিয়ে মামলাও চলছে। এতে ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান আরও খারাপ হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃ তফসিল, সুদ মওকুফ ও পুনর্গঠন করে সম্পদের মান ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। আর একে ঋণ আদায় হিসাবে দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। মুনাফা বাড়াতেই ব্যাংকগুলোর এসব উদ্যোগ।

নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অবশ্য খেলাপি হওয়া ঋণ ধীরে ধীরে আদায়ের পাশাপাশি আর যাতে না বাড়ে, সে ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ কমাতে নতুন পন্থা খুঁজছে।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের ২০১৮ সালের কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সোনালী ব্যাংক ছাড়া অপর তিনটি ব্যাংকের নগদ খেলাপি ঋণ আদায় আগের বছরের চেয়ে কমেছে। একই অবস্থা বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সমস্যা দুই রকম। সরকারি ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে। ব্যাংক পরিচালনার জন্য তাদের দক্ষতা ও জনবল নেই। এ কারণে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে, যেসব টাকা আদায়ের সম্ভাবনা কম।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলো খারাপ করেছেন কিছু পরিচালক। এসবের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকলেও বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমানে যেসব ব্যাংকের হাতে টাকা আছে, তারা ঠিকই ব্যবসা করছে। ঋণ দিচ্ছে, বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। আর অন্যরা ব্যস্ত আমানত সংগ্রহ ও ঋণ আদায় নিয়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমানতের সুদহার আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন ব্যাংকাররা। কারণ ঋণ দিতে হলে টাকা লাগবে, আর সেই টাকা আসবে আমানতকারী থেকে।

ব্যাংকাররা বলছেন, বর্তমান যে সুদহার তা দিয়ে ব্যাংকে আমানত সেভাবে বাড়বে না। কারণ ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি, শেয়ারবাজারে লেনদেন বাড়ায় সেদিকেও ছুটছেন অনেকে। নতুন করে সরকার গঠনের পর সরকারি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদারেরাও ব্যাংকের পেছনে ছুটবেন টাকার জন্য। এতে টাকার ওপর চাপ বাড়বে, সুদও বাড়বে।

ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংক ২০১৭ সালে খেলাপি ও অবলোপন ঋণ থেকে নগদ আদায় করেছিল ৭৯৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে নগদ আদায় করেছে ১ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন থেকে আদায় ৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপ একাই নগদ দিয়েছে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। গত বছরে গ্রুপটি সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করেছে। এ ছাড়া ডেল্টা জুট দিয়েছে ১০১ কোটি টাকা ও মুন্নু ফেব্রিকস ১৬ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ব্যাংকটি নগদ আদায়, পুনঃ তফসিল, পুনর্গঠন ও সুদ মওকুফ—এসব মিলিয়ে ৩ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় দেখিয়েছে।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরে আমাদের প্রকৃত খেলাপি ঋণ ২ হাজার কোটি টাকা কমেছে। খেলাপি ঋণ থেকে বড় অঙ্কের টাকা আদায় হয়েছে। এর মধ্যে বড় বড় প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ২০১৮ সালে আমরা ভালো করেছি।’

তবে রাষ্ট্র খাতের অপর তিনটি ব্যাংকের অবস্থা উল্টো। ২০১৭ সালের তুলনায় গত বছরে নগদ আদায় কমেছে অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের।

২০১৭ সালে অগ্রণী ব্যাংক খেলাপি ঋণ থেকে ৬৬৮ কোটি টাকা নগদ আদায় করলেও গত বছরে তা কমে হয়েছে ৩৯৮ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ব্যাংকটি সব মিলিয়ে ২ হাজার ৯৫ কোটি টাকা আদায় দেখিয়েছিল। গত বছরে তা কমে হয়েছে ১ হাজার ১০৫ কোটি টাকা।

এ নিয়ে ব্যাংকটির এমডি মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খেলাপি ঋণের বড় একটা অংশ ২০১৭ সালে আদায় হয়। যেগুলো সহজে আদায় করা যায়, তা ওই বছরে হয়েছে। যেসব ঋণ খেলাপি আছে, তা আদায় বেশ কষ্টসাধ্য। এ জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের সহায়তাও প্রয়োজন।

জনতা ব্যাংক ২০১৭ সালে খেলাপি ও অবলোপন করা ঋণ থেকে ৬২০ কোটি টাকা আদায় করেছিল। তবে গত বছরে খেলাপি ঋণ থেকে নগদ আদায় কমে হয়েছে ৫২০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে খেলাপি থেকে প্রায় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা আদায় দেখাচ্ছে ব্যাংকটি। জনতা ব্যাংক এখন বিপদে পড়েছে অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ নিয়ে। গ্রুপ দুটির কাছে আটকা পড়েছে ব্যাংকটির প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, যার বড় অংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে।

জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ বেশি কিছু বলতে চাননি। তবে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

রূপালী ব্যাংক ২০১৭ সালে খেলাপি ও অবলোপন করা ঋণ থেকে ৩০৫ কোটি টাকা আদায় করেছিল। গত বছরে তা কমে হয়েছে ২১৬ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ বেশ কমিয়েছে।

এ নিয়ে রূপালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়ে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সামনের দিনে আরও ভালো আদায় হবে।’

এদিকে বেসিক ব্যাংক ২০১৭ সালে খেলাপি থেকে ১৫৯ কোটি টাকা আদায় করেছিল, গত বছরে তা কমে হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা।

২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে সাড়ে চার গুণ। সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪৮ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এর বাইরে দীর্ঘদিন আদায় করতে না পারা যেসব ঋণ ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে, তার পরিমাণ প্রায় ৪৮ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা এই মন্দ ঋণ যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা।