সবজির সরবরাহ ব্যবস্থায় লাভের ভাগ সবচেয়ে কম পান দেশের কৃষকেরা। সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কৃষিপণ্য কৃষকের কাছ থেকে ভোক্তার কাছে যেতে অন্তত তিন দফা হাতবদল হয়। এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কৃষকের চেয়ে অনেক বেশি লাভ করেন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ২০১৭–১৮ অর্থবছরে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে তিনটি সবজির ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে লাভ ও মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ তুলে ধরেছে। এতে দেখা যায়, কৃষক যে আলুর দাম কেজিপ্রতি ৯ টাকারও কম পান, সেটি ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে দাম হয় ২২ টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০১৭–১৮ অর্থবছরে দেশে ৩৮ লাখ টনের কিছু বেশি সবজি উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২৩ লাখ টন শীত ও ১৫ লাখ টন গ্রীষ্মকালীন সবজি। অবশ্য হিসাবের মধ্যে আলু নেই। বিবিএসের হিসাবে, গত অর্থবছরে প্রায় ৯৭ লাখ টন আলু উৎপাদন করেছেন দেশের কৃষকেরা।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৭–১৮ অর্থবছরে এক কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় হয় ৭ টাকা ৬০ পয়সা। গড়ে ১ টাকা ২৫ পয়সা লাভে ওই আলু কৃষক বিক্রি করেন প্রতি কেজি ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দরে। স্থানীয় ব্যবসায়ী একই আলু কিনে বিক্রি করেন ১২ টাকা ২০ পয়সা দরে। এতে তাঁর ব্যয় হয় ১ টাকা ১০ পয়সা, লাভ হয় সোয়া ২ টাকা। পাইকারি বাজারে আলু বিক্রি হয় ১৭ টাকা ১৫ পয়সা কেজিতে। পাইকার ১ টাকা ৬০ পয়সা খরচ করে লাভ করেন ৩ টাকা ৩৫ পয়সা। খুচরা বিক্রেতা কেজিতে ৯০ পয়সা ব্যয় ও ৩ টাকা ৯৫ পয়সা লাভ করে আলু বিক্রি করেন প্রতি কেজি ২২ টাকায়।
একইভাবে প্রতি কেজি বেগুনে কৃষকের ১ টাকা ৮৯ পয়সা, স্থানীয় ব্যবসায়ীর আড়াই টাকা, পাইকারের ৪ টাকা ১৩ পয়সা ও খুচরা বিক্রেতার ৯ টাকা ৩৬ পয়সা লাভ থাকে। প্রতি কেজি টমেটোতে কৃষকের লাভ ২ টাকা ১০ পয়সা, স্থানীয় ব্যবসায়ীর লাভ ৩ টাকা, পাইকারের লাভ ৬ টাকা ৬০ পয়সা ও খুচরা বিক্রেতার লাভ ৭ টাকা ২৮ পয়সা।
জানতে চাইলে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার কৃষক জাহাঙ্গীর আলম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন ফুলকপি ৫ টাকা দরে বিক্রি করি, বগুড়া শহরে গিয়ে সেই ফুলকপিই ২০ টাকায় বিক্রি হতে দেখি।’ তিনি বলেন, কৃষিতে যে পরিমাণ ঝুঁকি, বিনিয়োগ ও পরিশ্রম, তাতে লাভ বেশি নয়। পরিবারের কেউ চাকরি না করলে, অথবা বিদেশে না থাকলে কৃষিকাজ করে মোটামুটি সচ্ছল জীবনযাপন করা সম্ভব নয়।
বেগুনে লাভ বেশি
অবশ্য সার্বিকভাবে সবজি চাষ কৃষকের জন্য লাভজনক। পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সমীক্ষায় বিভিন্ন ফসলে কৃষকের মুনাফার চিত্র উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৫ সাল থেকে ফুলকপি, মিষ্টিকুমড়া, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন ও আদা চাষের ওপর সমীক্ষা করে দেখেছে, এসব ফসল আবাদে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে তার বিপরীতে প্রায় শতভাগ লাভ হয়।
অন্যদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ২০১৭–১৮ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি একর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করতে কৃষকের ব্যয় হয়েছে ৭৬ হাজার ৮৭৪ টাকা। বিপরীতে তাঁর মুনাফা হয়েছে ৪০ হাজার ৬৬৬ টাকা। এক একর জমিতে রসুন আবাদ করলে মুনাফা হয় ৫৪ হাজার ৪৯৮ টাকা। আলুতে লাভ কম, ৩৫ হাজার টাকার মতো। বেগুনে অবশ্য মুনাফা বেশি, একরে প্রায় ৯৯ হাজার টাকা। টমেটো চাষে লাভ একরপ্রতি ৬৮ হাজার টাকার কিছু বেশি।
এবার শীত খারাপ কাটল
এবার শীত মৌসুমে বাড়তি সবজি আবাদ করে মন্দ সময় কেটেছে চাষিদের। প্রতিবার শীতে কখনো দাম বেশ বেড়ে যায়, কখনো কম থাকে। এবার পুরো শীতেই সবজির দর তুলনামূলক কম ছিল। বিশেষ করে পেঁয়াজ ও আলুচাষিরা খরচের টাকা ঘরে তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
কৃষক, ফড়িয়া ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীত মৌসুমে আগাম ও স্বাভাবিক সময় মিলিয়ে এ বছর সবজির আবাদ আগের বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে। পাশাপাশি আবহাওয়া ভালো থাকায় ফলনও ভালো হয়েছে। এ কারণে শীত মৌসুমের পুরোটা সময়ই বাড়তি সরবরাহ ছিল। ফলে দামের খুব একটা ওঠানামা হয়নি। পুরোটা সময় দাম বেশ কম ছিল।
রাজধানীর খুচরা বাজারে এখন বেশির ভাগ সবজির দর কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩৫ টাকার মধ্যে। কারওয়ান বাজারের আড়তে এসব সবজি মিলছে আরও কম দামে। কৃষক পর্যায়ে দাম একেবারেই নগণ্য। বগুড়ার মহাস্থানহাটে গত রোববার পাইকারি দোকানে প্রতিটি ফুলকপি ৭–৯ টাকা, বাঁধাকপি ৫–৬ টাকা, টমেটো প্রতি কেজি ১০ টাকা, শিম ১২–১৫ টাকা, মুলা ৫–৬ টাকা, আলু ৫–৬ টাকা ও ক্ষীরা ১৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
মহাস্থানহাটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছুদিন আগে দাম আরও অনেক কম ছিল। সে তুলনায় এখন কিছুটা বাড়তি। কারণ মৌসুম শেষ হয়ে আসছে। জানতে চাইলে মহাস্থানহাটের আড়ত মালিক মো. ফারুক মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, হাটে যে দামে সবজি বিক্রি হয়, তার চেয়েও কিছুটা কম দাম পান কৃষক। কারণ, তাঁর পরিবহন ও তোলার খরচ দিতে হয়। সব মিলিয়ে এবার বাজার খারাপ গেছে। চাষিরা দাম পাননি।