প্রকল্পের কাজ শুরু করতেই বিলম্ব

>

• এলওসির অর্থ ছাড়
• তিনটি এলওসিতে মোট ৭৫০ কোটি ডলার দেবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক
• এই পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৪৮ কোটি ডলার, এর প্রায় পুরোটাই প্রথম এলওসির

ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) ঋণচুক্তি হওয়ার পর মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে অনেক সময় চলে যায়। তাই অর্থ ছাড়েও বিলম্ব হয়। এর কারণ, বাংলাদেশ ও ভারত—উভয় পক্ষের নানা ধরনের প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা শেষে চূড়ান্তভাবে প্রকল্প অনুমোদিত হয়, এরপর শুরু হয় প্রকল্পের কাজ।

গত সাড়ে আট বছরে ভারতের প্রথম এলওসির ৮৬ কোটি ডলারের মাত্র ৫৫ শতাংশ বা ৪৮ কোটি ডলার অর্থ ছাড় হয়েছে। দ্বিতীয় এলওসির পরিমাণ ২০০ কোটি ডলার। প্রায় ৩ বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় এলওসির ১০ লাখ ডলারও ছাড় করা হয়নি। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে তৃতীয় এলওসিতে ৪৫০ কোটি ডলার দেওয়ার চুক্তি হয়। গত দেড় বছরে প্রকল্পই চূড়ান্ত হয়নি। তাই অর্থও ছাড় হয়নি। ভারতের এক্সিম ব্যাংকের দেওয়া ৩টি এলওসির মোট ৭৫০ কোটি ডলার দিয়ে ৪৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

কেন বিলম্ব হয়, তার খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, এলওসির অর্থ দিয়ে কোন কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে, সেই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে তার সারসংক্ষেপ প্রথমে ভারত সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হয়। ভারত সরকারের অনুমোদনের পর তা ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের কাছে যায়। এক্সিম ব্যাংক এলওসির প্রকল্প তালিকায় চূড়ান্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়ও প্রকল্প পাস হতে হয়। এরপর শুরু হয় প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ। পরামর্শক নিয়োগের পর দরপত্র আহ্বান, বাছাই, ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়া—এসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। এরপরই শুরু হয় মাঠপর্যায়ের কাজ।

ভারতের দেওয়া তিনটি এলওসির সার্বিক পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন নিয়ে গত সোমবার ইআরডি ও ভারতীয় পক্ষের মধ্যে বৈঠক হয়। শেরেবাংলা নগরের ইআরডি সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত ওই সভায় প্রকল্প বাছাই, অনুমোদন, কার্যাদেশ, অর্থ ছাড়ের কোথায় সমস্যা হয়, তা নিয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন ইআরডির অতিরিক্ত সচিব জাহিদুল হক এবং ভারতের নেতৃত্ব দেন ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার আদর্শ সোয়াইকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব জাহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সভায় এলওসির প্রকল্পগুলোর সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নিজেদের হাতে থাকা প্রকল্পসংক্রান্ত কাজ শেষ করতে উভয় পক্ষ একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। ফলে প্রকল্পের অনুমোদন থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, প্রথম এলওসির প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে আছে। দ্বিতীয় এলওসির প্রকল্পের অনুমোদনপ্রক্রিয়া প্রায় শেষ, বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আর তৃতীয় এলওসির প্রকল্প অনুমোদনপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

প্রথম এলওসি
প্রথম এলওসির জন্য ২০১০ সালের ৭ আগস্ট দুই দেশের মধ্যে ১০০ কোটি ডলারের এই ঋণচুক্তি হয়। পরে অবশ্য ১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার অনুদানে রূপান্তর করে ভারত। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ৪৮ কোটি ডলার ছাড় করা হয়েছে। প্রথম এলওসিতে প্রকল্পসংখ্যা ১৫। গত সাড়ে আট বছরে বেশির ভাগ প্রকল্পই শেষ হয়েছে। ওই সব প্রকল্পের মাধ্যমে এসি ও নন-এসি বাস, রেলের ইঞ্জিন ও বগি এবং মোংলা বন্দরের জন্য ড্রেজার কেনা হয়েছে। এ ছাড়া ভৈরবে মেঘনা নদীতে এবং আখাউড়ায় তিতাস নদে দ্বিতীয় রেলসেতু; আশুগঞ্জ-আখাউড়া রেলপথে সিগন্যালিং ব্যবস্থা উন্নত করা এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) শক্তিশালী করা হয়েছে।

দ্বিতীয় এলওসি
২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় ২০০ কোটি ডলার ঋণ বা দ্বিতীয় এলওসি দেওয়ার সমঝোতা চুক্তি হয়। পরে ২০১৬ সালের মার্চে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়। এ ঋণের আওতায় ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় বাংলাদেশ। ঋণচুক্তি হওয়ার পর এ পর্যন্ত ১২টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে এক্সিম ব্যাংক। এসব প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ১০ লাখ ডলারও ছাড় করা হয়নি বলে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে। তবে আগামী এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) জন্য ভারতের অশোক লেল্যান্ড থেকে কয়েক শ বাস-ট্রাক দেশে আসবে। তখন প্রায় ৮ কোটি ডলার ছাড় হবে।

এই পর্যন্ত অনুমোদন পাওয়া দ্বিতীয় এলওসির প্রকল্পগুলোর অন্যতম হলো আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়ক চার লেনে উন্নীত করা; সৈয়দপুরে রেলওয়ের ওয়ার্কশপ নির্মাণ; খুলনা-দর্শনা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ; পার্বতীপুর-কাউনিয়া রেলপথকে দ্বৈত গেজ করা; বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ; খুলনার মোংলা ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ভারতীয় অর্থনৈতিক জোন স্থাপন; সড়ক ও জনপথ বিভাগের জন্য যন্ত্রপাতি কেনা, ১২টি জেলায় হাইটেক পার্ক নির্মাণ; ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন।

তৃতীয় এলওসি
২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে তৃতীয় এলওসিতে ৪৫০ কোটি ডলারের চুক্তি হয়। তৃতীয় এলওসির অর্থ দিয়ে ১৬টি প্রকল্প করার প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো প্রকল্পই ভারতের অনুমোদন পায়নি।

তৃতীয় এলওসির মাধ্যমে বাংলাদেশ যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মোংলা ও ভেড়ামারায় ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন; মিরসরাইয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন; ১২ জেলায় হাইটেক পার্ক স্থাপন; ঢাকা-টঙ্গী এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর রেলপথ উন্নয়ন; খুলনা-মোংলা বন্দর রেলপথ নির্মাণে সমীক্ষা করা; খুলনা-শাহবাজ রেলপথ পুনর্বাসন; খুলনা-দর্শনা রেলপথ দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ; সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ নতুন করে নির্মাণের সমীক্ষা; পার্বতীপুর-কাউনিয়া রেলপথকে দ্বৈত গেজে উন্নীত করা; বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত দ্বৈত গেজ রেলপথ নির্মাণ; ঈশ্বরদীতে কনটেইনার ডিপো নির্মাণ; ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে এক লাখ এলইডি বাল্ব সরবরাহ প্রকল্প।