খেলাপি ঋণ বিষয়ে নীতিমালা শিথিলের উদ্যোগ

>

• খেলাপি ঋণ আদায় না করে নীতিমালা পরিবর্তন
• খেলাপি ঋণ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে
• পুনর্গঠন করা ঋণও পাবে বিশেষ সুযোগ

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এখন এক লাখ কোটি টাকার বেশি। এই ঋণ আদায়ে তেমন তৎপরতা নেই ব্যাংকগুলোর। এখন খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে অন্যতম হলো ঋণখেলাপির সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা। এই পরিবর্তনের ফলে নতুন করে খেলাপি হওয়া ঋণকে কমপক্ষে ছয় মাস ভালো ঋণ হিসেবে দেখাতে পারবে ব্যাংকগুলো। আবার পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণকে আরও কীভাবে দীর্ঘ মেয়াদে ভালো ঋণ হিসেবে রাখা যায়, এ নিয়েও কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব নীতি বাস্তবায়ন হলে কমে আসবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব উদ্যোগ ব্যাংক খাতের জন্য কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে। কারণ শুধু সময় বাড়িয়ে খেলাপি ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ।

এদিকে ঋণখেলাপি কমানোর পাশাপাশি ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত করতে একাধিক কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যাচাই করা হচ্ছে ব্যাংক কোম্পানি, অর্থঋণ আদালত, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, হস্তান্তরযোগ্য দলিল ও দেউলিয়াবিষয়ক আইনের দুর্বলতা। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে মার্জার বা একীভূত করতে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত করতে নমুনা ভিত্তিতে জনতা, এবি ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক পরিদর্শনও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ঋণের কিস্তি টানা তিন মাস পরিশোধ না করলে ওই ঋণকে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ছয় মাস কিস্তি পরিশোধ না করলে সন্দেহজনক এবং নয় মাস কিস্তি বকেয়া পড়লে ওই ঋণকে মন্দমানের খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হয়। এখন সেই নীতিমালা সংশোধন করে প্রথম পর্যায়ে টানা ছয় মাস ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে ওই ঋণকে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ১২ মাস কিস্তি বকেয়া পড়লে সন্দেহজনক ও দেড় বছর ঋণের কিস্তি শোধ না করলে ওই ঋণকে মন্দমানের ঋণ হিসেবে শ্রেণীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা পরিবর্তনের কাজও এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বর্তমানে যে নীতিমালাটি কার্যকর আছে, সেটি ২০১২ সালের।

নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা দেন, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না। এরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে খেলাপি ঋণ কমাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে ঋণ শ্রেণীকরণের যে নীতিমালা আছে, তা আন্তর্জাতিক মানের। এটা পরিবর্তন করা হলে ব্যাংকগুলো গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। বৈদেশিক ব্যবসার খরচ অনেক বেড়ে যাবে। কোনো খেলাপি দুষ্টচক্র কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্ররোচিত করে নীতিমালা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। আমি আশা করব, গভর্নর সেই ফাঁদে পা দেবেন না।’

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, ‘ব্যাংক খাতের সমস্যা ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়ে আছে। এখন এসব ঋণের সঙ্গে কারা জড়িত, কারা সুবিধাভোগী, তা বের করে আদায় জোরদার করতে হবে। আদায় না হলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সবার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। আর বেনামি ঋণের বিষয়ে যা শোনা যায়, তাও বের করতে হবে।’

এর আগে বড় ঋণখেলাপিদের জন্য ২০১৫ সালে বৃহৎ ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেওয়া হয়। ওই সুবিধার আওতায় দেশের বড় ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। বিশেষ সুবিধা নেওয়ার পরও এসব গ্রুপের বেশির ভাগই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে না। তাই ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দিয়েও এসব গ্রুপের কাছ থেকে খেলাপি ঋণের তেমন কোনো অর্থ আদায় করা সম্ভব হয়নি। উল্টো কয়েকটি গ্রুপ নতুন করে আরও ঋণ নিয়েছে। এখন নতুন করে নীতিমালা সংশোধন করে আবারও এসব গ্রাহককে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এদিকে ব্যাংক খাতকে রক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাঁরা খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনের ধারা, আইনের দুর্বলতা বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। আবার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন, বড় গ্রাহকদের আরও কীভাবে সহায়তা করা যায়, এসব বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এ কে এম আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে সহজে একীভূত হতে পারে, সে জন্য নীতিমালা তৈরিতে আর্থিক স্থিতিশীলতা বিভাগের জিএম কবির আহমদের নেতৃত্বে কমিটি করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ে ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগের জিএম শফিকুল ইসলামকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে অপর একটি কমিটি, যাঁরা ইতিমধ্যে তিনটি ব্যাংক পরিদর্শনও করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক খাতকে ঠিক রাখতেই বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কমিটিগুলো কাজ করছে। কার্যপরিধি অনুযায়ী কাজ শেষ হলে ব্যাংক খাতের জন্য ভালো কিছু হবে।