ফলে উচ্চ কর, দামে চড়া

ঢাকার বাজারে এক কেজি মাল্টার দাম এখন ২০০ টাকার বেশি, যা রমজান মাস শুরুর আগেও ১৩০ টাকা ছিল। ফলে শতকরা হিসাবে ফলটির দাম বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। চড়া দামের কারণে মাল্টার মতো একটি সাধারণ ফলও সীমিত আয়ের অনেক মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।

দেশি ফল খাবেন? মাঝারি আকারের একটি তরমুজের দাম এখন ৩০০ টাকা। এক ডজন সবরি কলা ১২০ টাকার নিচে পাওয়াই যায় না। বাড়তি চাহিদার সুযোগে ভালো পাকা পেঁপের দাম কেজিপ্রতি ১৪০ টাকায় উঠেছে। সব মিলিয়ে ইফতারের পদে ফল রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না সীমিত আয়ের মানুষেরা। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রোজার শুরুতেই বেশির ভাগ ফলের দাম ৩০-৪০ শতাংশ বেড়েছে।

শুধু রোজা নয়, বছরের অন্য সময় কি সীমিত আয়ের মানুষ ফলে খেতে পারছে? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা-আয় ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, মাথাপিছু ফল খাওয়ার হার কমছে। নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে সন্তানকে নিয়মিত ফল খাওয়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফলের এই উচ্চ দামের কারণ দেশে উৎপাদন যথেষ্ট হারে না বৃদ্ধি পাওয়া এবং আমদানিতে উচ্চহারে কর আরোপ। ফলের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কও আরোপ করে রেখেছে সরকার। সাধারণত কোনো পণ্যের ভোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য এ শুল্ক আরোপ করা হয়।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশে করনীতির ক্ষেত্রে ভোক্তার বিষয়টি একেবারেই অনুপস্থিত। কোনো বাজেট আলোচনায় ভোক্তা স্থান পায় না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করহার ঠিক করে অস্থায়ী ও তদবিরের ভিত্তিতে। তিনি বলেন, আম, আনারসের মতো যেসব ফল দেশে বেশি উৎপাদিত হয়, সেগুলোতে কিছু সুরক্ষা থাকতে পারে। আপেল, নাশপাতি, বেদানার মতো ফলে উচ্চহারে কর ভালো বিষয় নয়।

আহসান মনসুর নিজেদের একটি সমীক্ষার কথা উল্লেখ করে বলেন, বাড়তি শুল্কের কারণে দেশের মানুষকে পণ্য কিনতে বছরে ১ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা।

মোটামুটি পাঁচটি মাল্টায় এক কেজি ওজন হয়। একটি মাল্টার দাম পড়ে ৪০ টাকা। এ হিসাব তুলে ধরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘নিজেরা না খেলেও বাচ্চার পুষ্টির জন্য দিনে একটি ফল খাওয়ানোর চেষ্টা করি। ধরেন, একটি মাল্টার দাম যদি ৪০ টাকা হয়, তাহলে মাসে খরচ দাঁড়ায় ১ হাজার ২০০ টাকা। কতজনের এ সামর্থ্য আছে?’

আয় বাড়ছে, ফল কমছে
দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মাথাপিছু আয়। কিন্তু মাথাপিছু ফল গ্রহণের হার কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১০ অনুযায়ী, ওই সময় দেশে মাথাপিছু ফল গ্রহণ ছিল গড়ে ৪৫ গ্রাম। ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, সেটা ৩৬ গ্রামে নেমেছে। সার্বিক চিত্রে দেখা যায়, মাথাপিছু ফল গ্রহণের হার সেভাবে বাড়েনি। ২০০৫ সালেও মাথাপিছু ফল গ্রহণের হার ৩৩ গ্রাম ছিল।

দেশে ফলের উৎপাদনও কমেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ৫০ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়েছিল। পরের বছর তা কমে ৪৯ লাখ টনে নামে। অবশ্য মূল্যের দিক দিয়ে ফল আমদানি কিছুটা বেড়েছে। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩২ কোটি ৭০ লাখ ডলারের ফল আমদানি হয়েছিল, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৪ কোটি ডলার বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরেও দেশে সাড়ে ৩২ কোটি ডলারের ফল আমদানি হয়েছিল। সে হিসাবে আমদানি তেমন বাড়েনি।

কর কত?
দেশে বেশি আমদানি হয় আপেল, কমলা, মাল্টা ও আঙুর। এসব ফল দেশে তেমন একটা উৎপাদিত হয় না। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের কাস্টমস ট্যারিফ শিডিউল অনুযায়ী, আপেল, কমলা, মাল্টা ও আঙুরের ওপর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩ শতাংশ এবং অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট বা এটিভি ৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট করভার দাঁড়ায় ৮৯ শতাংশ।

অবশ্য দেশে যে ফল বেশি হয়, সেটার ওপর কর তুলনামূলক কম। যেমন পেয়ারা আমদানির ওপর মোট করভার ৫৯ শতাংশ। কিন্তু দেশের চাষিরাই বিপুল পেয়ারা উৎপাদন করেন। আবার টিনের কৌটায়করে আমদানি করা কাজুবাদাম, পেস্তাবাদামের কর কিন্তু কম, ৩৭ শতাংশ, যা সাধারণত উচ্চ আয়ের মানুষেরা কেনেন।

ফল আমদানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এক কেজি আপেলে কর দাঁড়ায় ৪০-৪৫ টাকা, মাল্টায় ৩৭ টাকা, সাদা আঙুরে ৮০ টাকা, লাল আঙুরে ৯০ টাকা ও নাশপাতিতে ৪০ টাকা। দেশে মোট ফলের চাহিদার ৭০ শতাংশ আমদানি করে মেটানো হয়। ভারত ফল রপ্তানিকারক দেশ। সেখানে ফল আমদানিতে কিন্তু ৫০ শতাংশের মতো করভার। এ বছর রোজার কয়েক দিন আগে ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে আমদানিতে বিঘ্ন ঘটেছে। এ কারণে দাম আরও বেড়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন ওই ফল আমদানিকারক।