বাংলাদেশ এখন রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে দ্বিতীয়

বিশ্বে যে কয়েকটি দেশের রপ্তানি আয় খুব দ্রুত বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। গড় হিসাবে এক দশক ধরে দেশের রপ্তানি আয়ে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অগ্রসরমাণ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়, ওপরে আছে কেবল ভিয়েতনাম। বিশ্ববাণিজ্যের এ চিত্র উঠে এসেছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। এটি গত সপ্তাহে প্রকাশ করা হয়। সব মিলিয়ে বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশ এখন ৪২ তম বড় রপ্তানিকারক দেশ, অন্যদিকে আমদানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩০তম।

রপ্তানিতে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রার অগ্রভাগে পোশাক খাত। একটু পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, বৈশ্বিক পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ২০০০ সালে পোশাক বাজারে এ দেশের হিস্যা ছিল আড়াই শতাংশের কিছু বেশি। এটা গেল বছর সাড়ে ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এতে পোশাক রপ্তানিতে একক দেশ হিসেবে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

অবশ্য এত সুখবরের মধ্যে কপালে ভাঁজ ফেলার মতো খবরও আছে। বাংলাদেশের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে ভিয়েতনাম। ২০১৮ সালে বৈশ্বিক পোশাক বাজারে ভিয়েতনামের হিস্যা দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশ একটু ওপরে আছে। কিন্তু ২০১৮ সালে বাংলাদেশের হিস্যা যেখানে কিছুটা কমেছে, সেখানে ভিয়েতনাম বেশ এগিয়েছে। ২০১৮ সালে ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির হার ছিল ১৩ শতাংশ, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ছিল ১১ শতাংশ। দুই দেশেরই রপ্তানি আয় ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের মতো।

>ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ-২০১৯ শীর্ষক প্রতিবেদন
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রতিবেদনটি গত সপ্তাহে প্রকাশ করা হয়
বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশ এখন ৪২তম বড় রপ্তানিকারক দেশ
রপ্তানিতে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার অগ্রভাগে পোশাক খাত


বাংলাদেশের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির পেছনের কারণ জানতে চাইলে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি ও শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফারুক হাসান তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘পোশাকের নতুন বাজার খোঁজা ও নতুন নতুন পোশাক পণ্য উৎপাদনে আমরা নিয়মিত প্রচেষ্টা চালিয়েছি, এখনো চলছে। আরেকটি দিক হলো যন্ত্রপাতি ও উৎপাদন প্রক্রিয়া উন্নত করতে অব্যাহত বিনিয়োগ।’ ফারুক হাসানের মতে, তৃতীয় কারণটি হলো পোশাক খাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করতে কারখানার মালিকেরা সফল হয়েছেন।

চীনা হিস্যা ভিয়েতনামে
বৈশ্বিক পোশাক বাজারে চীনের হিস্যা কমছে। ২০১৭ সালের তুলনায় সাড়ে ৩ শতাংশ কমে ২০১৮ সালে চীনের হিস্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ শতাংশের বেশি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও বাংলাদেশের হিস্যাও কিছুটা কমেছে। বেড়েছে ভিয়েতনামের। তাহলে চীনা ব্যবসা কি ভিয়েতনামেই বেশি যাচ্ছে?

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এখন পর্যন্ত চীনা ব্যবসা আমরা পাচ্ছি না। ভিয়েতনাম অনেক বেশি পাচ্ছে। এর কারণ শুল্ক সুবিধা ও সংস্কৃতি। বাংলাদেশের অবকাঠামো এখনো ভালো নয়।’ তিনি বলেন, কম্বোডিয়ার মতো দেশে প্রস্তুত জমি পাওয়া যায়। গ্যাস-বিদ্যুৎ সহজেই মেলে। বাংলাদেশের মতো তারা বলবে না যে এখন টাকা দাও, কয়েক বছর পরে জমি পাবে।

ভিয়েতনাম এত ভালো কীভাবে করছে, আরেকটি ব্যাখ্যা দেন ফারুক হাসান। তিনি বলেন, ভিয়েতনাম কৃত্রিম তন্তুর পোশাক বেশি রপ্তানি করে, যার দাম বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশও নয়।

আর কেউ পারেনি
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবশ্য রপ্তানি খাতের হিস্যা এখনো কম। ডব্লিউটিওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জিডিপিতে পণ্য ও সেবা রপ্তানি খাতের অবদান দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশে। স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে অ্যাঙ্গোলা (৩৮.৬ %), কম্বোডিয়া (৭৪ %) ও মিয়ানমারের (২৪.৫ %) হার আরও বেশি।

এদিকে পোশাক খাত ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো খাত রপ্তানিতে তেমন এগোতে পারেনি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৫৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে পোশাক খাতের হিস্যা ৮৪ শতাংশ। এটি বছর বছর বাড়ছে। অন্যদিকে চামড়া, হোম টেক্সটাইল, পাট, চিংড়ি ইত্যাদি খাত একটি গণ্ডির মধ্যে আটকে গেছে।

এগুলোকে একটি ‘হতাশাজনক চেষ্টা’ হিসেবে উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, মোদ্দা কথা হলো দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিদেশিরা পুঁজি, বাজার ও প্রযুক্তি নিয়ে আসবে। যেটা ভিয়েতনামে, ফিলিপাইনে হয়েছে। এ দেশে বিদেশি বিনিয়োগ যেটুকু আসছে, তার বেশির ভাগটাই জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি খাতে। উল্লেখ করে তিনি বলেন, পোশাক খাতেও বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। বিজিএমইএ তো সেটা চায় না।

পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহ না দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘পোশাক খাতের সংযোগ শিল্পে (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) বিদেশি বিনিয়োগ এলে আমরা খুব খুশি হব। সেটা আমাদের খুব দরকার। কারণ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর পোশাক রপ্তানিতে দেশীয় কাপড় ব্যবহার না করলে বাণিজ্য সুবিধা মিলবে না।’ তিনি মনে করেন, পোশাক খাতে যেসব ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা সক্ষমতা অর্জন করেছেন, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগের দরকার নেই।