অর্থনৈতিক মন্দা যেভাবে শুরু হয়

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পরিসরে ‘অর্থনৈতিক মন্দা’ শব্দটি খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদেরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দার সতর্কবার্তা দিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে বিশেষত অর্থবাজারের সঙ্গে যুক্ত মানুষের মধ্যে একধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও অনেকের পক্ষেই এই সতর্কবার্তা এবং এর কার্যকারণ বোঝা সম্ভব কঠিন।

গণতন্ত্রের সংকটের এই কালে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি যেমন খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি অর্থনীতির সংকটকালে ‘মন্দা’ শব্দটিও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একটির সঙ্গে জড়িত থাকে প্রত্যাশা, অন্যটির সঙ্গে শঙ্কা। গুগল জানাচ্ছে, তাদের সার্চ ইঞ্জিনে গত কয়েক সপ্তাহে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ‘রিসেশন’ শব্দটি খোঁজার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এই শব্দের প্রতিটি ব্যবহার এ বিষয়ে শঙ্কাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা যেকোনো সময় বাজার অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়ে বসতে পারে। মন্দা শব্দটি বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে এতটাই উচ্চারিত হচ্ছে যে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘গণমাধ্যম এই সংকট তৈরি করছে। অর্থনীতি ভেঙে ফেলার জন্য মিডিয়া যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।’ তাঁর অভিযোগ পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁকে পরাজিত করতেই এই অভিসন্ধি গণমাধ্যমের।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে ট্রাম্পের এ বক্তব্যও মন্দাকেই সামনে নিয়ে আসছে। তিনি এই সংকটের জন্য গণমাধ্যমকে দায়ী করলেও একই সঙ্গে স্বীকার করেছেন, অর্থনীতিতে কিছুটা ধীরগতি আছে; তবে তা চীনের সঙ্গে হওয়া সংকটের কারণে। প্রেসিডেন্ট মুখে যা-ই বলুন না কেন, হোয়াইট হাউস, এমনকি প্রেসিডেন্ট নিজেও এ বিষয়ে বেশ সতর্ক। ফলে তিনি বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ফোনালাপ করেছেন। ফলে তাঁর মুখের কথা ও কাজের মধ্যে থাকা ব্যবধানটি শেষ পর্যন্ত শঙ্কাটিকেই সামনে আনছে।

এ–সম্পর্কিত বিশ্লেষণে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাজির করা ষড়যন্ত্রতত্ত্বটি ভিত্তিহীন, মন্দার শঙ্কাটি নয়। যেকোনো সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো করে মন্দার মুখে পড়তে পারে অর্থনীতি। বর্তমানে এ নিয়ে যে সংশয় কাজ করছে, তার পেছনে বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসের অবদান কম নয়। সর্বশেষ অর্থনৈতিক মন্দাটির প্রথম ধাক্কা লেগেছিল পুঁজিবাজারে। ২০০০ সালের আগস্ট ও ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে যথাক্রমে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ৩০ শতাংশ ও নাসদাকে ৬০ শতাংশ অবনমন হয়। বর্তমানে অবস্থা অতটা খারাপ নয়। গত বছরের তুলনায় বরং বিভিন্ন সূচক ভালো অবস্থানে রয়েছে বলা যায়। কিন্তু সব সময় মন্দার লক্ষণ প্রথম পুঁজিবাজারেই আসবে, তেমনটি ভাবা ঠিক নয়।

মূলত মন্দার লক্ষণ বিচারে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচককে আমলে নিতে হয়। একটি অর্থবছরের পরপর কয়েকটি প্রান্তিকে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সূচক যদি নিম্নমুখী হয়, তবেই মূলত মন্দার লক্ষণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), শিল্প উৎপাদন, চাকরির বাজারসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকে সম্প্রসারণের বদলে সংকোচনের লক্ষণ দেখা দিলেই শঙ্কাটি তৈরি হয়। এই অবস্থায় ডলারের মতো মুদ্রার বিনিময় মূল্য, জ্বালানি তেলের দামের উত্থান-পতন, শক্তিশালী অর্থনীতির দেশের গুরুত্বপূর্ণ নীতি বদল ইত্যাদি বড় প্রভাবক হয়ে ওঠে। জ্বালানি তেলের বাজারে উল্লম্ফন হলে তা পুরো বিশ্বের উৎপাদনেই প্রভাব ফেলে। সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। এসব উপাদানই একসঙ্গে মন্দার ক্ষেত্রটি তৈরি করে।

চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে, সেখানে শুল্কারোপের মাধ্যমে দুটি দেশের উৎপাদন খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এর ধাক্কা চীন নিলেও, পাল্টা হিসেবে দীর্ঘ মেয়াদে তা যুক্তরাষ্ট্রসহ এর ইউরোপীয় মিত্রদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে। উন্নত দেশগুলোর বাজার এভাবে আক্রান্ত হলে নিশ্চিতভাবেই এর প্রভাব এসে পড়বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর। বর্তমান বিশ্বকাঠামোয় একটি দেশকে থেকে অন্য দেশ থেকে আলাদা করা বেশ কঠিন। একইভাবে অর্থনীতির একটি সূচক অন্য সূচকগুলোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ফলে কোনো একটি সূচকে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিলে তা খুব সহজেই অন্য সূচকগুলোকে আক্রান্ত করে।

তবে ইকোনমিস্ট বলছে, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কোনো একটি বিশেষ সূত্র দিয়ে নির্ধারণ করাটা খুবই কঠিন। যেমন উচ্চ সুদহার একটি জনগোষ্ঠীর সবার জন্য ইতি বা নেতিবাচক বলা যাবে না। একটি অংশ এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্য একটি অংশ উপকৃত হবে। আবার অনেকের ওপর এর কোনো প্রভাব না–ও পড়তে পারে। ঠিক যে রকম বড় কোনো কোম্পানির পতন, তার কর্মী ও অংশীদারদের জন্য ভয়াবহ হলেও প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য একটি শুভবার্তা এনে দেয়। আবার অর্থনীতিতে হওয়া সব ধসই মন্দার কারণ হয়ে ওঠে না। কোনো একটি ধস তখনই মন্দার কারণ হয়, যখন অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো নড়বড়ে থাকে। মন্দার সূত্রটি মূলত থাকে জনপরিসরে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক প্রবণতার মধ্যে।

অর্থনীতিতে কোনো একটি ধাক্কা যদি মানুষকে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল হয়ে ওঠার মতো শঙ্কিত করে তোলে, তবেই একধরনের মন্দাভাব দেখা দেয়। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে রক্ষণশীল হয়ে উঠলে, বাজারের গতি ধীর হয়ে যায়। ফলে যেকোনো ধাক্কাতেই সে হুড়মুড় করে পড়ে যায়। তাই অর্থনৈতিক ধাক্কার পরে নয়, বরং তার আগে থেকেই মন্দার প্রবণতাটি শুরু হয়। যখন মানুষ সম্পদের ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়, তখন থেকেই এর শুরু।

ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কিনেসের মতে, আয় ও ব্যয়ের ধারাবাহিকতার ওপরই একটি অর্থনীতি নির্ভরশীল। মানুষ আয়ের নিশ্চয়তার ওপর ভিত্তি করেই ব্যয় করে। এই নিশ্চয়তায় কোনো ধরনের ব্যত্যয় হলেই অর্থনীতিতে ঝাঁকুনি লাগে। তাই অর্থনীতির সংকট শেষ পর্যন্ত মন্দায় উপনীত হবে কি না, তা অনেকাংশে গণমানুষের মানসিক অবস্থার ওপরও নির্ভরশীল। অর্থনীতিতে বিদ্যমান সংকট বা আশু সংকট নিয়ে দুর্ভাবনা যদি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যয় সংকোচনের প্রবণতা তৈরি করে, তবে তা অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

ঠিক এই ঘটনাই এখন ঘটছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বৈরথ, ইরান ইস্যুতে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের হওয়া দূরত্ব, লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির কারণে প্রদর্শনধর্মী উন্নয়ন নীতিসহ নানা বিষয়ে একই সঙ্গে জারি থাকায় সারা বিশ্বেই সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে এই দেশই নয় শুধু, বিশ্বের অন্য দেশগুলোয়ও একধরনের শঙ্কা কাজ করছে। উৎপাদন ও পরিবহনব্যবস্থায় সংকট স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইরান ইস্যুতে মধ্যপ্রাচ্য আবার উত্তাল হওয়ার শঙ্কা, যা জ্বালানি তেলে সরবরাহের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

মানুষের মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একধরনের অস্থিরতার শঙ্কা, তাই বেশ ভালোভাবেই দানা বেঁধে আছে। এরই ফলে হোয়াইট হাউস থেকে চীনা পণ্যে নতুন করে শুল্কারোপের ঘোষণা আসার পরপরই পুঁজিবাজার নড়ে ওঠে। এর সঙ্গে যখন অর্থনীতিবিদদের বারবার সতর্কবার্তাটি যুক্ত হয়, তখন কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে জিডিপি যে সূচকের ভালো থাকার কথাই বলা হোক না কেন, তা আর মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারে না। আর এই আশ্বাসহীনতাই মন্দার ক্ষেত্রটি তৈরি করে।